আপনারা আনিসুল হকের 'মা' গল্পটি পড়েছেন, জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' পড়েছেন। এই দুইটা গল্পই অপেক্ষার গল্প। আপনারা এই অপেক্ষার গল্প পড়ে কেঁদেছেন, আর আমরা এই অপেক্ষা নিজের চোখে দেখেছি...

এক

ঠিক করেছি বিজয়ের মাসে আমি একটি আনন্দের গল্প লিখবো। একটি বিজয়ের গল্প বলবো। 

মুক্তিযুদ্ধের এক যুগ পর আমার জন্ম। ৭১ নিয়ে যেসব গল্প জেনেছি, শুনেছি, পড়েছি, সবই লোকমুখে অথবা পত্রিকায় কিংবা সিনেমা দেখে। প্রতিবছর যখন স্কুলে নতুন বই পেতাম, সবার আগে বাংলা বইয়ের সবার শেষের গল্পটি পড়তাম। ক্লাস টু থেকে আমার এই অভ্যাস ছিল। আমি যখন যেখানে যুদ্ধের গল্প পেয়েছি, পড়েছি। তবুও আমি জানি, আমার কিছুই পড়া হয়নি। 

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি গল্প শুনিয়েছেন আমার বাবা।  এবং সব গল্প একই টাইপ ছিল। এই একই টাইপ গল্পগুলো এতবার শুনেছি যে কখনো কখনো চোখ বন্ধ করে এই যুদ্ধটিকে দেখতেও পেতাম আমি। 

যেমন যুদ্ধে চলাকালীন সময়ে আমাদের বাসার ছাদের চিলেকোঠার ঘরে অনেক অস্ত্র লুকানো ছিল। আমার নানা সেসময় পাকিস্তানের মন্ত্রী এবং একজন বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাই আমাদের বাসা কখনোই সন্দেহের তালিকায় ছিল না। আমার বড় মামা যুদ্ধে যাবার আগে আমার আম্মাকে বলেছিলেন, তিনি না আসতে পারলেও তার বন্ধুদের যেন এই সময়ে ফিরিয়ে দেয়া না হয়। আমার আম্মা তার কথা রেখেছিলেন। 

আমার মামা আর ফেরত আসেনি, তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মামার বন্ধুরা রাতের অন্ধকারে আমাদের বাসায় আসতেন।  ছাদের ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে খেতে তারা যুদ্ধের গল্প করতেন। তারপর ভোর হবার আগেই অস্ত্র নিয়ে আবার চলে যেতেন। 

পুরো নয় মাস আমাদের বাসা একটি লুকোনো ঘাঁটি ছিল ঢাকার গেরিলাদের জন্য। কিন্তু শেষের দিকে এই ঘাঁটি আর গোপন থাকলো না। ১৪ তারিখে আমাদের বাসার আশেপাশের যত শিক্ষিত লোকজন আছে,  প্রায় সবাইকে ধরে নিয়ে গেলো পাকিস্তানী হানাদাররা। আমার নানার জন্য তখনও আমার বাবা সন্দেহের বাইরে ছিলেন। 

১৪ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী যাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে খুব বেশি দূরে যেতে হয়নি, আমাদের বাসার বিপরীত পাশেই ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। সেখানে সবাইকে নদীমুখো লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে যখন গুলি করা হচ্ছিলো, তখন নাকি সেই গুলির শব্দে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতটাই নিস্তব্ধ যে, নদীর পারে দাঁড়ানো মানুষগুলোর পরিবার সেই গুলিবর্ষণের শব্দ শুনেও নাকি বাসায় বসে চিৎকার করে কাঁদতে পারেনি! সে গল্পগুলোও আমি শুনেছিলাম। 

যাদেরকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল, তাদের পরিবারের সন্তান এবং বিধবা স্ত্রীদের কাছে ছোটবেলায় অনেক আদর-স্নেহ পেয়েছি। অতএব বছরের পর বছর বহন করা ১৪ই ডিসেম্বরের নিহত শহীদ পরিবারের শব্দহীন কান্না আমি সবসময়ই বুঝতে চাইতাম।  

১৪ ডিসেম্বরের পর যখন শিক্ষিত ব্যক্তিদের নাম দিয়ে আরেকটি লিস্ট তৈরী হয়, সেখানে ফাইনালি আমার বাবার নাম আসে। সে সূত্র ধরেই ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে দুপুরের দিকে আমাদের বাসায়  অভিযান চালিয়ে হানাদাররা শেষমেশ ছাদের ঘরের সন্ধান পায়।  অতঃপর আমার বাবাকে যখন একদল হানাদার ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন রাস্তার উল্টোদিক থেকে আরেকদল হানাদার আসে। সে দলের লিডার গোছের কেউ এই দলের লিডারের কানে কানে কি যেনো বলে। 

খুব সম্ভবত কানে কানে বলা কথাগুলো তখন বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জন্য সবচেয়ে আনন্দের কোনো সংবাদ বহন করছিলো। কথাটুকু শুনেই আমার বাবাকে তারা ছেড়ে দেয়। ওই মুহূর্তে, ওই জায়গায়। 

এই গল্পটি আমি কম করে হলেও আমার বাবার মুখে একশোবার শুনেছি। বাসার সামনে রাস্তার ঠিক যে জায়গাটিতে আমার বাবাকে ছেড়ে মুক্ত করে দেয়া হয়, সেই জায়গায় গিয়ে আমি অনেকবার দাঁড়িয়ে থেকেছি। সেইদিনকার কানে কানে বলা সেই সংবাদটি আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ঐসংবাদটি না আসলে, আজকে আমি এই গল্পটি হয়তো লিখতেই পারতাম না।  

বাবার সাথে লেখিকা

দুই

আমার বড় মামার নাম ছিলো খসরু। ৯০ দশকে টিভিতে তখন এক সাগর রক্তের বিনিময়ের গানের টিউন শুনে শুনে আমাদের কান পেকে গেছে। প্রতিদিন দশটার খবরের আগে এই সুর। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে 'ওরা এগারো জন' সিনেমাটি তখন বিটিভিতে দেখাতো। আর আমার আম্মা আবেগ নিয়ে সেই সিনেমা দেখতো। 

এই সিনেমার প্রধান অভিনেতা খসরুও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অন্যদিকে পরিচালক চাষি নজরুল ইসলাম ছিলেন আমার খসরু মামার মেন্টর এবং আম্মার দূর সম্পর্কের ভাই। সম্পর্ক দূরের হলেও ৭১ পূর্ববর্তী সময়ে উনার নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল আমাদের বাসায়। 

অতএব প্রতিবছর 'ওরা এগারো জন' সিনেমাটি টেক্সটবুকের মতো বাধ্যতামূলক দেখতেই হতো আমাদের। আমার আম্মা বোধহয় তার চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ভাইকে অভিনেতা খসরুর মধ্যে খুঁজতেন...

সেই সিনেমা দেখে আমি একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেই মেয়েটির কথা, যে তার আলু থালু চুল আর খুলে যাওয়া শাড়ির আঁচল নিয়ে নিয়ে যুদ্ধ শেষে লুটিয়ে পড়েছিল অভিনেতা খসরুর কোলে।  কী হয়েছিল তার? আমার বয়স ছিল তখন সাত আট বছর, সেই বয়সে আমার বাবা গণধর্ষণের অংশটুকু আমাকে আর বলেননি। আমাকে আমাদের বীরাঙ্গনাদের গল্প বইয়ে পড়ে জানতে হয়েছিলো। 

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খন্ড খন্ড আবেগগুলো আমাদের পরিবারকে কখনোই ছেড়ে যায়নি। আপনারা আনিসুল হকের 'মা' গল্পটি পড়েছেন, জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' পড়েছেন। এই দুইটা গল্পই অপেক্ষার গল্প। এই দুইটি বই পড়ে কান্না করেনি এমন বাংলাদেশী আমি অন্তত দেখিনি। আপনারা এই অপেক্ষার গল্প পড়ে কেঁদেছেন, আর আমরা এই অপেক্ষা নিজের চোখে দেখেছি।

এখন ২০২০ সাল, স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর। অথচ এখনো আমার পাগলী টাইপ আম্মা মনে করেন- গুলি খেয়ে তার ভাই বোধহয় স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এখনো বাড়ি ফিরে আসেনি। কে জানে, হয়তো সে কোথাও সংসার করছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালো আছে। বেঁচে আছে। 

মায়ের সাথে লেখিকা

বুঝলেন? প্রতি ডিসেম্বর মাসে আমাদের এই অপেক্ষাটা দেখতে হতো। 

ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় আমার আম্মার ভীষণ মন খারাপ হতো। এই দিনটির সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি ছিল- সেদিন আমাদের বাসায় পোলাও মাংস রান্না করা হতো; পুরোবাড়ি পোলাওর গন্ধে মৌ মৌ করতো, কিন্তু যার জন্য রান্না হতো সে দিনশেষে কখনোই আসতো না। ঠিক এই অংশটুকু, কি যে ভয়াবহ কষ্টের, সেই কষ্ট বোঝার জন্য আমার  ৭১ দেখার দরকার পরেনি কখনো।

১৬ই ডিসেম্বর হলো বিজয় দিবস। আমাদের জন্য বিরাট আনন্দের দিন হবার কথা। কিন্তু আমাদের মতন কত অসংখ্য পরিবারকে যে এই দিনটিতে মন খারাপ করে বসে থাকতে হতো, কে জানে! 

''সবকটা জানালা খুলে দাওনা ... ওরা আসবে ...চুপি চুপি ..''

এই গানটি আপনাদের মনে আছে না? জানেন, আমার পুরো ছেলেবেলা এই লাইনটি বিশ্বাস করেই কেটেছে। আম্মার অপেক্ষা দেখতে দেখতে, প্রতি ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলায় আমার সত্যি সত্যি মনে হতো, এই বুঝি পাড়ার সব হারিয়ে যাওয়া গেরিলারা ফেরত আসলো। 

সীমাহীন অপেক্ষার এই শূন্যতা বোঝার জন্য  ৭১ নিয়ে লেখা মোটা মোটা বই পড়ার বোধহয় খুব বেশি দরকার হয় না।  তবুও এই দিনটি আনন্দের। কানে কানে দেয়া বিজয়ের সংবাদটি ছিল আনন্দের। আমার বাবা যখন ১৬ ডিসেম্বর রাস্তায় মানুষের পতাকা নিয়ে ছোট ছোট মিছিলের বর্ণনা করতেন, সেই সময় তার চোখের মাঝে চিক চিক করে উঠা অশ্রুটি  ছিল আনন্দের। আমাদের ছাদে যখন ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পতাকা উত্তোলন হলো, সেই সন্ধ্যার আলোটি ছিল আনন্দের। 

এতো এতো আনন্দ ঘেরা এই দিনটিকে নিয়ে আমি একটি আনন্দের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, একটি বিজয় দিবসের গল্প বলতে চেয়েছিলাম। বড় হবার পর বুঝতে পেরেছি ১৬ই ডিসেম্বর নিয়ে একটি আনন্দের গল্প বোধহয় এই দেশের কোনো মানুষই ঠিকঠাক করে লিখতে পারবে না, অন্তত যাদের পরিবার যুদ্ধকালীন সময়টার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। আফসোস আমার একটি আনন্দের গল্প লেখা হলো না।

ফিচার্ড ছবি: লেখিকার কন্যা- সারা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা