গত ঈদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ২৫০০ টাকা করে মোট ১২৫০ কোটি টাকা উপহার দিয়েছিলেন। কোথায় গেল সে টাকা?

না মানে বলছিলাম গত ঈদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ঈদ উপহারের কথা। করোনার থাবায় বিপর্যস্ত নিম্নশ্রেণীর মানুষ যখন পেট ও ভাতের বিচ্ছেদ আশংকায় দিন যাপন করছে, তখন ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ২৫০০ টাকা উপহার ছিল তীব্র খরতাপে এক পশলা বৃষ্টির মতোই স্বস্তি ও আনন্দের উপলক্ষ্য। সত্যি বলতে এই খবর জেনে খুব খুশি হয়েছিলাম। এই প্যাকেজের সুবিধাভোগী না হবার পরেও কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম এমন ঘোষণায়।

৫০ লাখ পরিবার ঈদের দিন পেটপুরে খেতে পারবে, ৫০ লাখ পরিবারের বাচ্চাদের অন্য বাড়ির মাংস-সেমাইয়ের গন্ধে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করতে হবে না; এই অসাধারণ ব্যাপারটার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নীরব কৃতজ্ঞতা কাজ করছিল। গরীব মানুষের টাকা বরাবরই মার খায়। আশা করেছিলাম এই ২৫০০ টাকা অন্তত হতদরিদ্র মানুষগুলো হাতে পাবে। এই মহাদুর্যোগে চারপাশে অনেক লুটপাট হয়েছে, কীভাবে জানি আশাবাদী ছিলাম এই সামান্য টাকায় হয়তো কেউ হাত বাড়াবে না। আশার বেলুন একেবারে চুপসে গেল এতদিন পর যখন টাকার হিসেব পেলাম।

প্রত্যেক পরিবারের ২৫০০ টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য মোট ১২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী  

পাঁচ দিন আগে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হলো, ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে মাত্র ১৬ লাখ ১৬ হাজার পরিবার প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হাতে পেয়েছে। তার মানে ১২৫০ কোটি টাকার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৪০৪ কোটি টাকা। বাকি ৮৪৬ কোটি টাকা এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। সেই ঈদ পার হয়ে অন্য আরেকটা ঈদ চলে এসেছে। ৩৪ লাখ পরিবারের ৮৪৬ কোটি টাকা কবে হাতে আসবে? প্রশ্ন হলো ৫০ লাখ পরিবারের তালিকা স্পষ্ট থাকার পরেও কেন ৩৪ লাখ পরিবারের হাতে টাকা গেল না?

এই প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্টরাই ভালো দিতে পারবেন। পত্রিকা পড়ে ও এই সুবিধাধীন কিছু মানুষের সাথে কথা বলে কিছু কিছু কারণ জানতে পেরেছি। সুবিধাবঞ্চিত বেশ কিছু মানুষের নিজের বিকাশ বা নগদ একাউন্ট নেই। কারো কারো নেই নিজস্ব সিমকার্ডও। কীভাবে একাউন্ট করতে হবে, কী করে টাকা হাতে আসবে, কার সাথে কথা বলতে হবে...এই প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা নেই।

এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না, হাতে গোণা। এদের টাকা না পাওয়ার একটা যৌক্তিক কারণ তাও পাওয়া গেল। কেউ কেউ ভুগেছে অন্য ঝামেলায়। নিজেদের আইডি কার্ডের সাথে মন্ত্রণালয়ের সার্ভারে থাকা আইডি নাম্বার ম্যাচ করেনি। আইডি নাম্বার না মিললে সে দায় নিশ্চয়ই গরীব মানুষটির নয়। হয় কারো খামখেয়ালি কিংবা দায়িত্বে অবহেলা এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে; নয়তো ইচ্ছে করেই ঝামেলা বাঁধিয়ে টাকা সরানো হয়েছে অন্য কোথাও। কারণ যাই হোক, এর দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে।

গরীব মানুষ সফটওয়্যার জানে না, আইডি নাম্বারের মিসম্যাচিং তাদের বোঝার কোনোই দরকার নেই। ২৫০০ টাকা তাদের প্রাপ্য। ঝামেলা যাই হোক, দুই মাস পরে এসেও সেটা সলভ করা যাচ্ছে না, এই অযুহাত মেনে নেয়া অসম্ভব।

মাত্র ২৫০০ টাকা, অথচ এই লোভ কত লোক সামলাতে পারছে না। ৫০ লাখ পরিবারের তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা, পেনশনভোগী উচ্চবিত্ত চাকুরে, কোটিপতি রাজনীতিবীদ সবাই যেন উৎসবের সাথে নাম লিখিয়েছে। সরকারি হিসেবেই এমন লোভীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। ৫ লাখ টাকাওয়ালা মানুষ ৫ লাখ গরীব পরিবার কিংবা ২৫-৫০ লাখ হতদরিদ্রের খাবার কেড়ে নিতে চেয়েছে শুরুতেই। আশার কথা, মন্ত্রণালয় নাকি রিভিউ করে এই ৫ লাখকে বাদ দিয়েছে।

৫০ লাখ গরীব পরিবারের তালিকায় অনেক উচ্চবিত্ত, সরকারি কর্মকর্তাদের নামও ছিল   

সত্যিই বাদ দিয়েছে কিনা কে জানে। যদি বাদ দিয়ে থাকে তবে এই সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তবে উচিত ছিল ২৫০০ টাকার লোভীদেরকে ২৫ হাজার থেকে নিয়ে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা এবং ১২৫০ কোটি টাকার ফান্ডে এই টাকাটাও জমা করা।

রিভিউ করে আরো জানা গেছে তালিকায় ৫৬৬ জন মহামানব আছেন, যাদের কাছে ব্যাংকের ন্যূনতম ৫ লাখ টাকার সেভিংস সার্টিফিকেট আছে। কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে রেখে গরীবের ২৫০০ টাকার দিকে হাত বাড়াতে এদের লজ্জা লাগল না? কোন হিসেবে এদেরকে লিস্টে নেয়া হলো? কে এই তালিকা প্রণয়ন করল? যারা লিস্টে এসেছে এবং যারা এনেছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল না? শাস্তি দূরে থাক, ইনাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে কিনা সেটাই কেউ বলতে পারছে না।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো তিন লাখ নাম আছে যারা তালিকায় একাধিকবার এসেছে। একাধিক মানে ঠিক কত সেটা জানা যায়নি। আমরা যদি ধরে নিই একাধিক মানে সর্বনিম্ন দুই, তাও ছয় লাখ ফ্রড নেইম আছে তালিকায়। এই ভুলকে কীভাবে ব্যাখা করবেন? এটাকে ভুল বললে পাপ হবে। এটা ভয়ংকর প্রতারণা।

৫০ লাখ মানুষের তালিকায় ৫ লাখ উচ্চবিত্ত চাকরিজীবী, ৬০০ জন ব্যাংকপতি এবং কম হলেও ৬ লাখ ফ্রড নেইম। তাহলে আর কত থাকে বাকি? যে ১৬ লাখ পরিবার টাকা পেয়েছে বলে হিসেব দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এই ফ্রডরা থাকতে পারে না? কমনসেন্স তো বলে গরীবের আগে এরাই প্রায়োরিটি বেসিসে টাকা পাবে। ৩৪ লাখই যদি বাকি থাকে, দরিদ্ররা তাহলে টাকা পেল কই? পুরো লেখায় আমি "মাত্র ২৫০০" টাকা অনেকবার বলেছি। কিন্তু ২৫০০ টাকাগুলো যোগ করলে যে ১২৫০ কোটি টাকা হয়ে যাচ্ছে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

হতদরিদ্র মানুষ ২৫০০ টাকার হিসেব জানে। তারা যদি জানত এখানে আসলে আড়াই হাজার নয় বরং প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাজ কারবার চলে তাহলে হয়তো টাকার আশা ছেড়ে দিত বহু আগেই।

একটা পয়েন্ট মিস হয়ে গেছে। ১২৫০ কোটি টাকা মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য সার্ভিস চার্জ হিসেবে আরো সাত কোটি টাকার বাজেট আছে। মানুষ যদি টাকা না ই বা পায়, এই সাত কোটি সার্ভিস চার্জ হিসেবে ধরাই হলো বা কেন?

মানসিকভাবে আমার গত ঈদ যতটা খারাপ কাটার কথা ততটা খারাপ কাটেনি। খারাপকে ভালো করার মূল কারণ ছিল এই আড়াই হাজার টাকার প্যাকেজ।

হতদরিদ্র মানুষের ভীড়ে থাকি। অনেক মানুষ অভুক্ত হয়ে কাতরাচ্ছে, অর্ধভুক্ত হয়ে চোখের পানি ফেলছে, বাচ্চারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা-মায়ের দিকে...এমন কিছু জানার পর ঈদ ভালো কাটে কীভাবে বলেন? নিজের সেই সার্মথ্যও নেই সবার পাশে দাঁড়ানোর। আড়াই হাজার টাকা মন অনেকখানি হালকা করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে এখন নিজেকেই প্রতারিত মনে হচ্ছে। আশা দেখার পর আশাহত হলে মানুষ আরো বেশি কষ্ট পায়। এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে আশা দেখানোর পর যা ঘটল তারপর তাদের ঈদ কতখানি খারাপ কেটেছে সেটা উপরমহলের কেউ বুঝবে কী?

যে পাপ হয়ে গেছে সেটা তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। অন্য এক ঈদ চলে এসেছে। দাবী জানাচ্ছি হতদরিদ্র মানুষজনের প্রাপ্য টাকাটা যেন এই ঈদের আগেই দিয়ে দেয়া হয়। যে লোভী, পাপিষ্ট ও প্রতারকরা এই টাকায় হাত গলিয়ে দিয়েছে তাদের শাস্তির দাবী করছি। ঘোষণা দেয়ার মাঝেই কৃতিত্ব শেষ হয়ে যায় না। টাকা মানুষের হাত অব্দি গেল কিনা তার খোঁজ রাখাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আশা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই হতদরিদ্র মানুষগুলোকে তাঁর আওতাধীন বোয়ালদের থাবা থেকে রক্ষা করবেন। চুরি বহু করছেন, বহু করবেনও আরো। এই সামান্য টাকা থেকে লোভ সরিয়ে নেন প্লিজ। প্লিজ ২৫০০ টাকা প্রত্যেকটা দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছিয়ে দিন।

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা