৯২ বছরের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি আগে, এবার সেটাই ঘটলো অস্কারের মঞ্চে। আমেরিকা জয় করলো দক্ষিণ কোরিয়া। সাথে জোকারের দস্যিপনা।

প্রায় শতবর্ষের অস্কার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিদেশী চলচ্চিত্র অস্কারের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নিলো। শুধু সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেই ক্ষান্ত হয়নি দক্ষিণ কোরিয়ার প্যারাসাইট, সাথে জিতে নিয়েছে সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের পুরস্কারও। প্যারাসাইটের পরিচালক বং জুন-হো জিতেছেন সেরা পরিচালক এবং সেরা চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার। মোট ছয়টি ক্যাটাগরির নমিনেশন থেকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার জিতে এবারের অস্কারকে একদম নিজের করে নিয়েছে এ বছরে সর্বোচ্চ হাইপ তোলা চলচ্চিত্র প্যারাসাইট।     

৯২ বছরের অস্কার ইতিহাসে মোট দশবার আন্তর্জাতিক কোনো চলচ্চিত্র সেরা চলচ্চিত্রের নমিনেশন পেয়েছিলো, প্যারাসাইটের আগ পর্যন্ত অস্কারজয়ী আলফেন্সো ক্যুরোনের রোমা চলচ্চিত্রটি খুব কাছাকাছি গিয়েছিলো অস্কারের। তবে সেরা চলচ্চিত্র বাদে তিনটি অস্কার জিতেছিলো রোমা। অবশেষে ফরেন ফিল্মের সেই সাবটাইটেলের ট্যাবু ভাঙলো প্যারাসাইট। এই কারণে পরিচালক বং জুন-হো একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। মার্টিন স্করসেসি, কুয়েন্টিন টারান্টিনো, স্যাম মেন্ডেসের মতো লিজেন্ডারি পরিচালকদের পেছনে ফেলে জিতেছেন তিনি। এই জয় চাট্টিখানি কথা নয়।

এ বছর ফরেন ফিল্মের নামে অস্কার ফাজলামোর একটা বিহিত করে দিয়েছে প্যারাসাইট। এবারের গোল্ডেন গ্লোব জিতে বং জুন-হো বলেছিলেন, ‘আমরা যখন সাবটাইটেলের দুই ইঞ্চি উপর থেকে সিনেমা দেখা শুরু করবো তখন থেকেই সেটা উপভোগ করা যাবে।’ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ বছর ইন্টারন্যাশনাল ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে নাইজেরিয়ার সাবমিশন লায়নহার্ট চলচ্চিত্রটি এক্সেপ্টই করেনি একাডেমি এওয়ার্ডস কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, এটি নাকি ইংলিশ ফিল্ম। তাই ফরেন ক্যাটাগরিতে এক্সেপ্ট করা যাবে না। এদিকে ইংলিশ কিন্তু নাইজেরিয়ার অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ। এ কেমন বিচার? এমন সব বিবেচনার জন্যেই অস্কার কখনো কলঙ্কমুক্ত হবে না। 

৯২তম অস্কারের বিজয়ীরা 

সেরা অভিনেতার অস্কার জিতে নিয়েছেন জোকার চরিত্রকে পুনর্জীবন দানকারী ওয়াকিন ফিনিক্স। এ বছর তিনি সিল্ভার স্ক্রিন কাঁপিয়েছেন জোকার দিয়ে। অবশ্য ম্যারেজ স্টোরি চলচ্চিত্রে এডাম ড্রাইভারের পার্ফরম্যান্সও দুর্দান্ত ছিলো। সেরাদের সেরা তো একজনই হয় তাই এবার একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস এর সদস্যরা বেছে নিয়েছেন এই ফিনিক্স পাখিকে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, একই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দ্বিতীয়বার অস্কার পেলেন কেউ। এর আগে ডন ভিটো কর্লিওনি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কার পেয়েছিলেন মারলোন ব্রান্ডো এবং রবার্ট ডি নিরো। তারপর জোকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কার জিতেছিলেন প্রয়াত হিথ লেজার। এবার জোকার চরিত্রে জিতলেন ওয়াকিন ফিনিক্স। ৯২ বছরের অস্কার ইতিহাসে একই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দুইজনের অস্কার পাওয়ার ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটলো। কোনো কমিকবুক ক্যারেক্টারের জন্যেও এটি দ্বিতীয় অস্কারজয়।   

সেরা অভিনেত্রীর অস্কার জয় করেছেন রেনে জ্যালওয়েইগার। অভিনয় জীবনে দ্বিতীয় অস্কার। সহ-অভিনেতার অস্কার জিতেছেন সুদর্শন ব্র্যাড পিট। এটি তার জীবনের প্রথম অস্কার জয়। ওয়ান্স আপন এ টাইম... ইন হলিউড চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে বহু প্রতীক্ষিত এই সম্মান ঘরে তুললেন তিনি। পার্শ্ব-অভিনেত্রীর অস্কার তুলে নিয়েছেন লওরা ডার্ন, ম্যারেজ স্টোরি সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় করে জীবনের প্রথম অস্কার জিতেছেন এই অভিনেত্রী। টয় স্টোরি-৪ পেয়েছে অস্কারের সেরা এনিমেটেড চলচ্চিত্রের সম্মান। ১৯১৭ চলচ্চিত্রের সিন্যামোট্রাফিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে অস্কার জিতেছেন রজার ডেকিন্স। সেরা ব্যাকরাউন্ড স্কোর কম্পোজ করে হিলদুর গুথনাতডুরটিয়ার জিতে নিয়েছেন অস্কার। ২০০০ সালের পর থেকে কমেডি এবং মিউজিকাল জনরা মার্জ করে দেবার পর এই প্রথম কোনো নারী এই বিভাগে অস্কার জিতলেন।

এক নজরে ৯২তম অস্কার বিজয়ীরা-

সেরা চলচ্চিত্রঃ প্যারাসাইট

সেরা পরিচালক: বং জুন-হো (প্যারাসাইট)

সেরা অভিনেতা: ওয়াকিন ফিনিক্স (জোকার)

সেরা অভিনেত্রী: রেনে জেলওয়েগার (জুডি)

সেরা পার্শ্ব অভিনেতা: ব্র্যাড পিট (ওয়ান্স আপন এ টাইম... ইন হলিউড)

সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী: লওরা ডার্ন (ম্যারেজ স্টোরি)

সেরা এনিমেশন চলচ্চিত্র: টয় স্টোরি ৪  

সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র: প্যারাসাইট (দক্ষিণ কোরিয়া)

সেরা এডাপ্টেড চিত্রনাট্য: বং জুন-হো ও হান জিন ওন (প্যারাসাইট)

সেরা  অরিজিনাল চিত্রনাট্য: জোজো র‍্যাবিট (টাইকা ওয়েইটিটি)

সেরা চিত্রগ্রহণ: রজার ডেকিন্স (১৯১৭)  

সেরা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস: জিওম রচেরন, গ্রেগ বাটলার, ডমিনিক টুহয় (১৯১৭)  

সেরা কস্টিউম: জ্যাকলিন ডুরান (লিটল উইমেন)

সেরা মেকাপ এবং হেয়ারস্টাইল: কাজু হিরো, এন মর্গান, ভিভিয়ান বেকার (বম্বশেল)

সেরা গান: আই এম গন্না লাভ মি আগেইন বাই এল্টন জন (রকেটম্যান)

সেরা অরিজিনাল স্কোর: হিলদুর গুথনাতডুরটিয়ার (জোকার)

সেরা সাউন্ড এডিটিং: ডোনাল্ড সিলভেস্টার (ফোর্ড ভার্সেস ফেরারি)

সেরা সাউন্ড মিক্সিং: মার্ক টেলর ও স্টুয়ার্ট উইলসন (১৯১৭)

সেরা সম্পাদনাঃ  (ফোর্ড ভার্সেস ফেরারি)

সেরা প্রোডাকশন ডিজাইন: বারবারা লিং ও ন্যান্সি হেই (ওয়ান্স আপন এ টাইম... ইন হলিউড)

সেরা শর্টফিল্ম: দ্য নেইবারস উইন্ডো  

সেরা ডকুমেন্টারি ফিচারফিল্ম: আমেরিকান ফ্যাক্টরি

সেরা ডকুমেন্টারি শর্টফিল্ম: লার্নিং টু স্কেটবোর্ড ইন এ ওয়ারজোন

সেরা এনিমেটেড শর্টফিল্ম: হেয়ার লাভ

এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা। অস্কারের মানদন্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। তোলারই কথা, প্রতিবছর কোনো না কোনো ব্লান্ডার এরা ঘটাবেই। এই যেমন মার্টিন স্করসেসির দ্যা আইরিশম্যান চলচ্চিত্রটি দশটি নমিনেশন পেয়ে একটিতেও জিততে পারেনি। নেটফ্লিক্সের প্রোডাকশন দেখে একাডেমী মেম্বারদের এই অনীহা কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই সাথে দ্যা লাউটহাউজ কিংবা আনকাট জেমসের মতো চমৎকার চলচ্চিত্রগুলোও ছিলো এবারের অস্কারে উপেক্ষিত।

হলিউডের মুভি দেখে যেহেতু আমরা অভ্যস্থ, তাই তাদের পুরস্কার বিতরণীর হাইপটাও আমাদেরই দেখা লাগে। চলচ্চিত্র নিয়ে তাদের মতামতকে একটু আকটু মূল্যায়ন তো করাই যায়। অথচ পুরোটাই গ্ল্যামারের খেলা। তাই আকর্ষনটাও তারা কেড়ে নিতে জানে। বর্তমানে শুধু হাইপ ক্রিয়েট করেই জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। অথচ একটা সময় ছিলো যখন পাচিনো কিংবা ক্যাপ্রিওর অস্কার জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। হাইপটা বাড়লেও, সেই উত্তেজনা এখন আর নেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা