
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছেন। পলাতক থাকার পর অবশেষে ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরা থেকে সাহেদ র্যাব এর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন তার বিচারের অপেক্ষায় পুরো দেশ। সাহেদের এত বড় বড় জালিয়াতি ও প্রতারণাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসার পিছনে যে ব্যক্তিটির মুখ্য ভূমিকা রয়েছে তিনি হলেন চ্যানেল ২৪ এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রিপোর্টার আব্দুল্লাহ আল ইমরান।
মূলত তার হাত ধরেই সাহেদের চাঞ্চল্যকর এসব প্রতারণার বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকে। সাংবাদিকতা সাহসিকতার ব্যাপার। একজন সাংবাদিককে দুঃসাহসী, নির্ভীক, নির্লোভ ও দৃঢ় হতে হয়। আব্দুল্লাহ আল ইমরান তেমনই এক দুঃসাহসী সাংবাদিকের নাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল ইমরান চ্যানেল ২৪ এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক। একই সাথে তিনি ক্রাইম রিপোর্টার ও ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করছেন। শুরু থেকেই পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞান, মেধা ও পরিশ্রমের সাথে তিনি তার দায়িত্ব সম্পাদন করে চলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নফাঁস এর মূল হোতাদের গ্রেফতার ও শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের পিছনে মূল নেপথ্যে ছিলেন এই ইমরান। তার প্রতিবেদনের মাধ্যমেই আমাদের অনেক অজানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিলো।
তেমনি তারই ধারাবাহিকতায় সাহেদের এরকম বহুমুখী প্রতারণার মুখোশ উন্মোচিত হয় ইমরানের হাত ধরে। এবার একটু পিছনের গল্প শোনা যাক। চ্যানেল ২৪ এর নিয়মিত প্রতিবেদন ’সার্চলাইট’ এর জন্য একটি প্রতিবেদন এর কাজ করতে গিয়েই রিজেন্ট হাসপাতালে সাহেদ এর জালিয়াতি সম্পর্কে আঁচ পান ইমরান। সেই ২২ জুন থেকে শুরু ইমরান ও তার টিম এর অনুসন্ধান। এরপর একে একে সাহেদের অসংখ্য জালিয়াতির সন্ধান পান ইমরান।
তখন পর্যন্ত যেসব প্রতারণার খবর শোনা যায়, সেগুলো হলো- করোনা টেস্টের নামে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া, বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে টাকা আদায় করা এবং টেস্ট না করেই ভূয়া সার্টিফিকেট দেয়া। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য ইমরান তার টিম নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরপর তারা নিজেদের একজনকে রোগী পরিচয় দিয়ে তার টেস্ট করার কথা বলে সাহেদ এর সাথে যোগাযোগ করেন। তারপর হাতেনাতেই সকল অভিযোগের সত্যতা পেয়ে যান। প্রায় ১৫ দিনের টানা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যখন তিনি ও তার টিম একটি পূর্ণাঙ্গ প্রমাণপত্র হাতে পান, এরপরই গত ৬ই জুলাই চ্যানেল ২৪ কে সাথে নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় র্যাবের অভিযান পরিচালিত হয়।
তারপর শুধুই ইতিহাস। বাকিটা কারো অজানা নয়। অভিযানের পর থেকেই আতঙ্কিত হওয়ার মতো একের পর এক অবিশ্বাস্য তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। বেরিয়ে আসতে থাকে সাহেদের প্রতারণার অসংখ্য উৎস। জানা যায় তার জালিয়াতি ও মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার এক অনন্য বাণিজ্য। এ যেন কেঁচো খুঁড়তেই সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা।
র্যাব এর সেই অভিযান পরিচালনা হওয়ার পর এবং চ্যানেল ২৪ এর সার্চলাইট ‘রিজেন্ট লিজেন্ড’ প্রতিবেদনটি সম্প্রচারিত হওয়ার পর জানা যায় রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার নামে চলছে অবিশ্বাস্য প্রতারণা ও অনৈতিক বাণিজ্য, সাহেদ যার মূল কারিগর। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতাল সরকার থেকেই সব সুবিধা গ্রহণ করে, অথচ করোনা টেস্টের নামে তারা হাজার হাজার টাকা রোগী থেকেই হাতিয়ে নেয়। এমনকি পরীক্ষা না করেই প্রায় কয়েক হাজার ভুয়া রিপোর্ট তারা প্রদান করে। তার চেয়েও বেশি অবাক করা বিষয় হলো, এত কিছুর পরও রিজেন্ট উল্টো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মাসিক প্রায় ২ কোটি টাকার বিল চেয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। সাহেদের হাত যে আরো অনেক বড়। হাসপাতালের বাইরে দীর্ঘদিন ধরেই সাহেদ আরো বিভিন্নভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। সরকারি, বেসরকারি প্রভাবশালী নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে রয়েছে সাহেদের সুসম্পর্ক। মূলত এটাকেই পুঁজি করে সাহেদ তার এই অসাধু কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। ব্যাংক সেক্টর থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে তার অবাধ বিচরণ রয়েছে। প্রতারণা করেছেন সবার সাথে। আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ও আত্মসাৎ, চেক জালিয়াতি, ভুয়া কোম্পানি খুলে গ্রাহকের টাকা হাতানো, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও সরকারের সাথে চুক্তি ভঙ্গ সহ আরো নানারকম অপকর্মের সাথে সাহেদ সরাসরি জড়িত।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, রাজধানীতে সাহেদ তার ভাড়াটে চালকদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে গাড়িধাক্কা দিয়ে আহত করে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য করাতো। এরপর তাদের চিকিৎসা বাবদ বিপুল অঙ্কের টাকা বিল করা হতো। টাকা পরিশোধ না করতে পারলে তাদের উপর অমানবিক আচরণও করা হতো। এমনকি সাহেদ রিকশাওয়ালা সহ সাধারণ মানুষদের সাথেও প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করেন। এসব অপকর্মের জন্য তার নামে মোট ৩২ টি মামলাও রয়েছে।
অর্থলিপ্সু, অমানুষ সাহেদের এসব অপকর্ম ফাঁস করে সামনে হতে যাওয়া আরো অজস্র জালিয়াতি থেকে ফিনিক্স পাখির মতো সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ইমরান নিগৃহীত মানুষদের উদ্ধার করেছেন। দেখিয়েছেন আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতটা নড়বড়ে ও দায়িত্বহীন। এসব সাংবাদিকরা আমাদের আশা জাগিয়ে তোলেন। আমাদের নিস্তেজ প্রাণে নতুন জীবনের সঞ্চার করেন। সহস্র ব্যর্থতা আর অপকর্মের মাঝেও তারা আমাদের ভেঙ্গে যাওয়া বিশ্বাসকে জোড়া লাগাতে চেষ্টা করেন।
যারা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, প্রতারণা করে ধোঁকা দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেন, ক্ষমতাবলে যা ইচ্ছা তা করে যান, তাদের দুঃসাহসিকতার কোন সীমা নেই। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না, তাদের অপকর্ম সহজে ফাঁস করা যায় না। এজন্য দুঃসাহসিকতা দেখাতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সেই দুঃসাহসিকতাকে পুঁজি করে ইমরান যা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, অভূতপূর্ব।
এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইমরানকে হুমকি দেয়া হয়েছে। জীবন ঝুঁকি নিয়েও ইমরান তবু পিছ পা হননি। বরং সততার সাথে তার অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছেন এবং পরিশেষে এমন একজন অমানুষের বহুমুখী প্রতারণার খাত জনসম্মুখে উন্মোচন করেছেন, যা আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে।
সাহেদের এই জালিয়াতির সাথে উপরের মহলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। সাহেদের সত্যিকারের মুখোশ উন্মোচন হওয়া মানেই আরো কয়েকজন প্রভাবশালীর আসল চেহারা প্রকাশ পাওয়া। আর এতেই ভয়। সাহেদ কি তাহলে পার পেয়ে যাবে ক্ষমতার বলে, নাকি আসলেই তার কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে! সাহেদের মতো ধোঁকাবাজ, প্রতারক, অপকর্মার মুক্তি পেয়ে যাওয়া মানেই ইমরানের মতো শত মহৎ প্রাণের সাথে প্রতারণা করা, জনগণের সাথে প্রতারণা করা। আমরা আশা করি সাহেদের এমন দৃষ্টান্তরূপে শাস্তি হবে যে, তা দেখে অনান্য দুর্নীতিবাজ ও দূষিত রাঘব-বোয়ালরা নিজেদের শুধরানোর চেষ্টা করবেন।
-
* প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে
আরও পড়ুন-