জনাব আবদুর রহিম বোধহয় ভুলে গেছেন, তিনি একজন সরকারী কর্মকর্তা, কোন ধর্ম প্রচারক নন। তার কাজ অফিসের কর্মকাণ্ড দেখভাল করা, কে হিজাব পরছে না, কে শাড়ি পরে অফিস করছে, কার কবীরা গুনাহ হচ্ছে- সেসবের তদারকি করা নয়...

আমাদের দেশের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশের মধ্যে কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। কোথাও হয়তো সরকারী ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে পার্কে অভিযান চালান, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করতে আসা যুগলদের পাকড়াও করেন, বাসায় ফোন দিয়ে হেনস্থা করেন। কোথাও আবার পুলিশের কাউকে দেখা যায় অপরাধী গ্রেপ্তার না করে সেলুনে গিয়ে তরুণদের চুল কেটে দিচ্ছে, পুলিশিংয়ের চেয়ে মরাল পুলিশিংয়েই তাদের আগ্রহ বেশি। 

আজও তেমনই একটা নজির দেখা গেল জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। আবদুর রহিম নামের এক 'সরকারী কর্মকর্তা' সেখানে ফতোয়া জারী করেছেন, পুরুষ কর্মকর্তাদের পায়ের গোড়ালির ওপরে পোশাক পরার এবং নারী কর্মকর্তাদের হিজাবসহ গোড়ালির নিচে পর্যন্ত কাপড় পরতে হবে। আবদুর রহিম জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। মৌখিক কোন আদেশ নয়, রীতিমতো লিখিত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন তিনি, বিজ্ঞপ্তিটি জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইটে না দিয়ে সরাসরি এই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাঠানো হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুর রহিম এই আদেশ দেয়ার পেছনে যেসব কুযুক্তি দেখিয়েছেন, সেটা শুনলে যে কোন সেন্সিবল মানুষই তাকে মাথামোটা এবং গর্ধভ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবেন না। অবশ্য মাথামোটা না হলে সরকারী অফিসে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে এমন আদেশ কারো দেয়ারও কথা নয়। 

এই বিজ্ঞপ্তি জারির পেছনে কারন হিসেবে আবদুর রহিম বলেছেন, "দেখছেন সারা দেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। সবাই ঠিক মতো ধর্মীয় বিধান মানলে তো এমন অবস্থা হতো না। তাই আমি আমার অফিসের সবাইকে সে অনুযায়ী পোশাক পরিধান করতে বলেছি।" অর্থাৎ আবদুর রহিমও ধর্ষণের কারন হিসেবে নারীর পোশাককেই দায়ী করলেন, তার ধারনা নারীরা টাখনুর নিচ পর্যন্ত কাপড় পরে বের হলেই ধর্ষণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। উচ্চপদস্থ একজন সরকারী কর্মকর্তার মানসিকতা যখন ফেসবুকের কমেন্টবক্সে বিষ্ঠা ত্যাগ করে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়াদের মতো হয়, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। 

এই সেই ব্যক্তিগত আদেশ সংবলিত বিজ্ঞপ্তি

একটা সরকারি অফিসে কেউ এ ধরণের ধর্মীয় ড্রেস কোড চালু করতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর রহিম বলেছেন, "আমি তো কোনো ড্রেস কোড চালু করিনি। শুধু সবাইকে বলেছি মুসলিমরা যেন তাদের ধর্ম অনুযায়ী পোশাক পরে অফিসে আসেন। ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী জীবন যাপন জরুরি বলেই মনে করি আমি।" জনাব আবদুর রহিম কি মনে করেন কিংবা করেন না, সেটার সঙ্গে তার অফিসের কর্মকর্তাদের সম্পর্কটা কোথায়? আবদুর রহিমের যদি ইচ্ছে হয়, তিনি আরবদের মতো জোব্বা-পাগড়ি পরে অফিস করবেন, কেউ তো তাকে বাধা দিচ্ছে না। কিন্ত অফিসের কে কি পোশাক পরে আসছে, সেটা দেখার বা ঠিক করে দেয়ার গুরুদায়িত্বটা তাকে কে দিয়েছে? 

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান, কারো বাপের টাকায় চলা কোম্পানী নয়। অফিস-আদালতের একটা ফরমাল ড্রেস কোড আছে, সেটা শার্ট-প্যান্ট হতে পারে, শাড়ি-সেলোয়ার কামিজ হতে পারে, বোরকা-হিজাবও হতে পারে। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে আসবে অফিসে, যার ইচ্ছে শাড়ি পরবে, যার ইচ্ছে সে হিজাব পরবে। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তা নিশ্চয়ই থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে অফিস করেন না যে, টাখনুর নিচে কাপড় পরার নির্দেশনা জারি করতে হবে। আবদুর রহমান কেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও কাউকে নির্দিষ্ট কোন পোশাক পরার জন্য বাধ্য করতে পারেন না, কারন সেই অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। খোদ হাইকোর্টের পক্ষ থেকেও এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে মহিলাদের বোরকা পরতে বাধ্য না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।

আবদুর রহিমের গোটা বক্তব্য জুড়ে শুধু বিনোদন আর বিনোদন। এই ভদ্রলোক এমন উর্বর মস্তিস্ক নিয়ে কীভাবে বিসিএসের মতো কঠিন একটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তারপর প্রমোশন পেতে পেতে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতো একটা প্রতিষ্ঠানেএ পরিচালক হলেন- তার কথাবার্তা শুনে মনে এমন প্রশ্নের উদয় হওয়াটা স্বাভাবিক। কেন তিনি এমন আদেশ জারী করেছেন, এর উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন- ‘ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছি। টাকনুর ওপরে যদি পুরুষ কাপড় পড়ে তাহলে তার কোনও গুনাহ নাই, টাকনুর নিচে পরলে সে কবিরা গুনাহ করলো। একইভাবে নারীদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য, নারীরা পর্দার ভেতরেই সুন্দর। টাকনুর নিচে কাপড় পরলে তার কবিরা গুনাহ হবে না। এই জিনিসটা আমাদের দেশে উঠে গেছে।’

জনাব আবদুর রহিম বোধহয় ভুলে গেছেন, তিনি একজন সরকারী কর্মকর্তা, কোন ধর্ম প্রচারক নন। তার অফিসটাও কোন ধর্মীয় উপাসনালয় নয়। কে পর্দার ভেতরে সুন্দর, কার কবীরা গুনাহ হবে, কে বেহেশতে যাবে, কে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবে- এসব ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়নি। তার কাজ অফিসের কর্মকাণ্ড দেখভাল করা, জনগন যাতে সর্বোচ্চ সেবাটা পায় সেটা নিশ্চিত করা। অফিসে ঘুষের লেনদেন হচ্ছে কিনা, কোথাও ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে কিনা, কেউ অনিয়ম বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে কিনা- সেটা দেখাই তার দায়িত্ব, যে টাখনুর ওপরে কাপড় পরেছে আর কে হিজাব পরে অফিসে এসেছে সেটার তদারকি করা নয়। 

আরেকটা হাস্যকর কথা তিনি বলেছেন। তার ভাষ্যমতে- 'এ দেশের কয়জন ইমাম-মুয়াজ্জিন, কয়জন হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ মারা গেছেন কোভিডে? আপনাদের সাংবাদিকদের অনেকেই গেছেন, পুলিশ গেছেন, ডাক্তার গেছেন- হেন পেশা নাই যে পেশাকে করোনা আক্রমণ করেনি, কিন্তু কয়জন ইমাম-মুয়াজ্জিন মারা গেছেন?' কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তারা সবাই পাপী ছিলেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর রহিম আবার একশো আশি ডিগ্রিতে ইউটার্ন নিয়ে বলেছেন- 'আমি এ কথা বলছি না। ধর্মীয় অনুশাসনের জীবনযাপন জরুরি। অন্যরা কোন কারণে মারা গেছেন সেটা আমি জানি না।'

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর

এই লোক নাকি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক! ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশ- এরা সবাই করোনাকালে ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র হিসেবে কাজ করেছেন। মসজিদ বন্ধ ছিল, মন্দির বন্ধ ছিল, গীর্জা বন্ধ ছিল। হাসপাতালে ফুলটাইম ডিউটি করেছেন ডাক্তারেরা, প্রয়োজনীয় সেফটি ইকুইপমেন্ট না থাকার পরেও কর্তব্যে একবিন্দু অবহেলা করেননি পুলিশ সদস্যরা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে ছুটেছেন সাংবাদিকেরা। আর জনাব আবদুর রহমান এসেছেন ডাক্তার-পুলিশ-সাংবাদিকের মরার খতিয়ান বের করতে! যে লড়ে, সে মরে- এটা তো জানা কথা। নিরাপদে ঘরে বসে থাকার সুযোগ থাকলে একজন ডাক্তার-পুলিশ বা সাংবাদিকও কি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরতেন?

ভীষণ দম্ভ নিয়েই আবদুর রহিম বলেছেন- 'আমি আমার অফিসের জন্য নির্দেশ দিয়েছি। আমাদের দেশ মুসলিম কান্ট্রি, আমাদের দেশে, আমার অফিসে যদি এভাবে সজ্জিত হয় আমার কাছে ভালো লাগবে। আমি একজন বিসিএস কর্মকর্তা। আমি আমার অফিস চালাবো আমার স্টাইলে।' আবদুর রহিমের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, শুধুমাত্র তার ভালো লাগা মন্দ লাগা বাস্তবায়নের জন্যেই তার অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করেন। তিনি আদেশ দিয়েছেন, তাই পুরুষেরা টাখনুর নিচে কাপড় পরে আসবেন, নারীরা হিজাব পরে অফিস করবেন। 

কারনটা তিনি নিজেই বলেছেন- তিনি একজন বিসিএস কর্মকর্তা, তিনি নিজের স্টাইলে অফিস চালাবেন! তার কথাই আইন, সেটা মানতে সবাই বাধ্য! ইংরেজরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেছে ৭৩ বছর আগে, কিন্ত কলোনিয়ালিজম যায়নি। একটু ক্ষমতাবান হলে নিজেদেরকেই এখন আমরা প্রভু ভাবতে শুরু করে দিই, 'বিসিএস অফিসার' আবদুর রহিমের আচরণ সেটার প্রকৃষ্ট একটা প্রমাণ। আবদুর রহিম বোধহয় ভুলে গেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ গাড়িচালক আবদুল মালেকের গালভর্তি দাড়ি ছিল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন তিনি, কাপড়ও টাখনুর নিচেই থাকতো। সেটা কিন্ত তার কয়েকশো কোটি টাকা অবৈধভাবে কামানোর পথে বাধা হতে পারেনি!

এই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা হয়েছে দিনভর। বিসিএস অফিসার আবদুর রহিমকে কারন দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে, তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাকে চিঠির জবাব দিতে হবে। এরকম দাম্ভিক এবং পশ্চাৎপদ মানসিকতার একজন লোক সরকারের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকার যোগ্য কিনা, সেটা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। এই লোকগুলো বাস করে বাংলাদেশে, নুন খায় বাংলাদেশ সরকারের, বাংলাদেশের জনগনের, কিন্ত মানসিকতা ধারণ করে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা