ফজলে হাসান আবেদ অস্ত্র হাতে নেননি, গুলি ছোঁড়েননি, নিজ হাতে একজন পাকিস্তানী সেনাকেও হত্যা করেননি। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের জন্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন, সেটা খুব বেশি মানুষের ভাণ্ডারে নেই।
একটা দুর্নাম আছে, বাঙালি নাকী কোন ব্যাপারেই একমত হতে পারে না, সর্বদাই সব বিষয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ফজলে হাসান আবেদের প্রস্থানে বাঙালীকে এক হতে দেখেছিলাম, দল-মত আর ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল, তার জন্যে শোক প্রকাশ করেছিল, রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে তার চরিত্রহননের চেষ্টা হয়নি, মৃত্যুসংবাদের নিচে ফেসবুক ব্যাকটেরিয়াদেত নোংরা কমেন্টও চোখে পড়েনি তেমন। মানুষটাই তো এমন ছিলেন, সবার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা যিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন নিজের কর্মগুণে।
ফজলে হাসান আবেদের এটা প্রাপ্যই ছিল, বাংলাদেশের জন্যে তিনি যা করেছেন, যে অবদান তিনি রেখেছেন, এর চেয়েও অনেক বেশি সম্মান তিনি ডিজার্ভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি দেশের জন্যে অন্যরকম একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্ত আবেদের যুদ্ধটা থামেনি। সেটা রূপ নিয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের যুদ্ধে, যেটা তিনি চালিয়ে গিয়েছেন জীবনভর। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ফজলে হাসান আবেদ বা তার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের যুদ্ধটার গল্প অনেকেই জানেন, এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে, হবে। কিন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধে ফজলে হাসান আবেদ যে অবদান রেখেছিলেন, যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, এই বিদায়বেলায় সেই গল্পটা না শোনালে একটা অপূর্ণতা তো রয়েই যাবে।
পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় যখন তাণ্ডবলীলা শুরু করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, ফজলে হাসান আবেদ তহ্ন চট্টগ্রামে, তার কর্মস্থলে। দুই-তিনদিন লেগে গেল সেখান থেকে ফেরী পার হয়ে ঢাকায় আসতেই। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ঢাকাকে দেখেই আবেদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্ত পালানো তো এত সোজা নয়, পাকিস্তানীরা প্রত্যেক বাঙালিকে সন্দেহ করে, আবেদককেও তারা চোখে চোখে রেখেছে। তার ওপর এসে জুটলো নতুন আবদার, লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে সারা দেশে তেল সরবরাহ-ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব তাকে দেয়া হলো। আদেশ না মানলে গুলি এসে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে শরীরকে।
দিন সাতেক মনের বিরুদ্ধে গিয়েই কাজটা করলেন, তারপর পালালেন ঢাকা থেকে। মে মাসের ঘটনা সেটা। পালিয়ে ঢাকা থেকে করাচী গেলেন আবেদ, তবে সেটা গা ঢাকা দিয়ে নয়, স্বাভাবিক মানুষের মতোই গেলেন তিনি, লুকোচুরির কোন ব্যাপার ছিল না। এমন একটা ভাব করছিলেন, যেন জরুরী কাজে লন্ডন যাচ্ছেন। করাচী থেকে গেলেন ইসলামাবাদে।
সেখানে গিয়েই হলো বিপদ। ইসলামাবাদে পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেন ফজলে হাসান আবেদ। অভিযোগ, তিনি ঢাকার অফিসে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে এসেছেন। আইএসআইয়ের লোকেরা আবেদকে তাদের এক কর্নেলের কাছে নিয়ে গেল। তাকে আটক করে চলল বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্ত কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুদিন পরে তিনি মুক্তি পেলেন। তাকে পরামর্শ দেয়া হলো ঢাকায় ফিরে যাওয়ার।
কিন্ত ঢাকায় ফেরার জন্যে তো তিনি ইসলামাবাদে যাননি। গা ঢাকা দিয়ে পেশোয়ার চলে এলেন ট্যাক্সিতে চড়ে, গন্তব্যস্থল আফগানিস্তান। পেশোয়ারের এক হোটেলে রাত কাটালেন, মনের ভেতরে শঙ্কা, বর্ডার পার হতে অয়ারবেন তো? কিন্ত পেছনে ফেরার কোন পথ নেই। পরদিন সকালবেলা খাইবার পাসের বাস ধরে চেকপোস্ট পেরিয়ে প্রবেশ করলেন আফগানিস্তানে। এরপর আবারও বাসে করে জালালাবাদ, সেখান থেকে দীর্ঘ, ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে কাবুল। শেষে কাবুল থেকে লন্ডন।
ফজলে হাসান আবেদ অস্ত্র হাতে নেননি, গুলি ছোঁড়েননি, নিজ হাতে একজন পাকিস্তানী সেনাকেও হত্যা করেননি। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের জন্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন, সেটা খুব বেশি মানুষের ভাণ্ডারে নেই। লন্ডনে পৌঁছে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন আবেদ, কারণ ঢাকা থেকে মোটামুটি খালি হাতেই আসতে হয়েছিল তাকে, তখন তো আর অনলাইন ট্রানজেকশনের যুগ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে হবে, তাই নিজের বাড়িটা বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন তহবিলের জন্যে।
লন্ডনে বন্ধুদের নিয়ে 'অ্যাকশন বাংলাদেশ' এবং 'হেল্প বাংলাদেশ' নামের দুটো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফজলে হাজান আবেদ। প্রথমটির কাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যে গণহত্যা আর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে, সেগুলো বিশ্ববাসীকে জানানো, বাঙালির পক্ষে জনসমর্থন জোগাড় করা। ব্রিটিশ এমপিদের কাছে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং অমানবিক নৃশংসতা তুলে ধরা হলো। পার্লামেন্ট অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার জন্যও দেনদরবার চললো। ইংল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গিয়ে সে দেশের জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন তারা। বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষ করে রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার প্রদান করে আবেদ ও তার বন্ধুরা পাকিস্তানিদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরলেন।
আর 'হেল্প বাংলাদেশ' নামের যে সংগঠনটি ছিল, সেটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার চেষ্টা করলো। সীমান্তের ওপাড়ে শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করলো তারা। এছাড়া আরেকটা উদ্যোগ নেয়া হলো, ভাড়াটে মার্সেনারী যোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধে কাজে লাগানোর। বিশাল অংকের ফান্ড জোগাড় করা হলো, মুজিবনগরের প্রবাসী সরকারের কাছেও প্রস্তাব পাঠানো হলো এই ব্যাপারে। কিন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ রাজী হলেন না, তিনি পরামর্শ দিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে এই টাকা ব্যয় করতে। পরে সেটাই করা হলো।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল একাত্তরের ডিসেম্বরে, কিন্ত ফজলে হাসান আবেদের যুদ্ধটা শেষ হয়নি। দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে তিনি লড়ে গেছেন আমৃত্যু। সেই লড়াইয়ের গল্প বলা শুরু হলে আর শেষ হবে না। ফজলে হাসান আবেদ তো শুধু একজন উদ্যোক্তা বা সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন, এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তার প্রত্যক্ষ্য অবদান ছিল, জীবন বাজী রেখে তিনি দেশকে স্বাধীন করার জন্যে ঢাকা ছেড়েছিলেন। ঠিক এক বছর আগে সেই মানুষটা আমাদের ছেড়ে গেছেন চিরতরে, তাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করাটা তো পুরো জাতিরই কর্তব্য...