অভিজিৎ ব্যানার্জী: খুনের আসামী থেকে নোবেল বিজয়ী!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

জেলে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল ছাত্রদের, রেহাই পাননি অভিজিৎও। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলো তার বিরুদ্ধে, এমনকি মামলা দেয়া হলো খুনের চেষ্টার অভিযোগে...
যে ভালো রাঁধে, সে নাকি চুলও বাঁধে। অভিজিৎ ব্যানার্জী চুল বাঁধতে পারেন কিনা জানা নেই, তবে তিনি যে সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ, সেটা তার নোবেলপ্রাপ্তির পরেই জানা যাচ্ছে। সবশেষ বাহাত্তর ঘন্টায় সর্বভারতীয় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির এই অধ্যাপক। প্রতিদিনই সাংবাদিকেরা বের করে আনছেন তার জীবনের অতীত অধ্যায়ের গল্পগুলো। সেখান থেকেই এবার জানা গেল, নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ নাকি খুনের মামলার আসামী ছিলেন, তিহার জেলে দশদিন বন্দী হিসেবেও কাটিয়েছেন!
দিন কয়েক আগেও কলকাতার বাইরে খুব বেশি মানুষ মনে হয় না তার নামটা জানতো। হ্যাঁ, অভিষেক এমআইটির অধ্যাপক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ- এইটুকু পরিচয় তো ছিল বিজ্ঞমহলে। কিন্ত সেই মানুষটা যে নোবেল জয় করে ফেলবেন- এটুকু আশা করেনি অনেকেই। কাজেই খবরটা চমক হিসেবেই এসেছে পশ্চিমবঙ্গে, সেই ঘোর কাটার সঙ্গে সঙ্গে অভিনন্দনের বন্যা বইয়ে দিয়েছে ভারতের মানুষ। যদিও সরকারে থাকা বিজেপি একটু দোটানায় ভুগেছে অভিজিৎকে অভিনন্দন জানানোর আগে, কারণ নরেন্দ্র মোদির সরকারের অর্থনৈতিক নীতির কড়া সমালোচক অভিজিৎ।
অভিজিৎ ব্যানার্জীর জন্ম মুম্বাইয়ে, বাঙালী এক পরিবারে। মা-বাবা দুজনই ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি নিজেও সেই পথেই হেঁটেছেন। বেড়ে ওঠা কলকাতায়, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ছিল তাদের বাড়ি, পুরনো শহরের আলো বাতাস গায়ে মেখে বড় হয়েছেন তিনি। সাউথ পয়েন্ট স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ- এসব ছিল তার চারণভূমি। উচ্চশিক্ষার জন্যে দিল্লিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, দিল্লির বিখ্যাত জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটিতে (জেএনইউ) তার শিক্ষাজীবনের ছোট্ট একটি অধ্যায় কেটেছে।
মামলা আর হাজতবাসের ঘটনাটা তখনকার। ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী এক ভাবমূর্তি ছিলেন অভিজিৎ, এখনও আছেন। অন্যায় তিনি সহ্য করতে পারেন না, অনিয়ম দেখলে সেটার কড়া সমালোচনা করেন। ১৯৮৩ সাল, অভিজিৎ তখন জেএনইউ'র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ইন্দিরা গান্ধী তখন ক্ষমতায়। দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বভাবতই ফুঁসে উঠেছে ভারতের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ও।
ছাত্রজীবনে বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জী, তার পরিবারও বাম পন্থার সমর্থক। বিপ্লব তার রক্তে গাঁথা। সেই অস্থির সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্টকে অবৈধভাবে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে তারা ঘেরাও করলেন উপাচার্য্যের কার্যালয়। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডাকা হলো ভিসির অফিসের সামনে, ভেতরে আটকা পড়লেন ভিসি। দাঙ্গা পুলিশ এসে পিটিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের সরিয়ে দিলো সেখান থেকে, মুক্ত করে নিয়ে গেল ভিসিকে। পুলিশের মারে আহত হলো অনেকে, গ্রেফতার করা হলো শ'খানেক আন্দোলনকারীকে। তাদের একজন ছিলেন বাইশ বছরের অভিজিৎ ব্যানার্জী, কলকাতার এক টগবগে তরুণ, মুখে যার প্রতিবাদের ভাষা, অন্তরে যার দ্রোহের আগুন।

গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হলো পুনের তিহার জেলে। সেখানে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল সবাইকে, সেই মার থেকে রেহাই পাননি অভিজিৎও। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলো সবার বিরুদ্ধে, এমনকি মামলা দেয়া হলো খুনের চেষ্টার অভিযোগে, যা কিনা পুরোপুরি ভিত্তিহীন! বলা হলো, অভিজিৎরা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন! এসব কথা অভিজিৎ নিজেই বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে, ২০১৬ সালে বিজেপিবিরোধী হাওয়ায় যখন জেএনইউ ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠেছিল, কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ বা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মতো ছাত্রনেতাদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছিলো, তখন নিজের সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করেছিলেন এমআইটির এই অধ্যাপক। অভিজিৎ বলেছিলেন, রাষ্ট্র তখন যেমন অবিবেচক ছিল, এখনও তেমনই আছে। রাষ্ট্র বরাবরই প্রতিবাদকে ভয় পেয়েছে, প্রতিবাদীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিতে চেয়েছে।
এমনিতে অভিজিৎ ব্যানার্জী প্রচণ্ড শান্তশিষ্ট মানুষ, তাকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এই লোকটা বুকের ভেতর আগুন লুকিয়ে রাখেন। স্ত্রী এস্তার দুফলো এবং আরেক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমারের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হবার পরে এমআইটিতে আয়োজিত এক সভায় এসেছিলেন অভিজিৎ, সেখানে তিনি খানিকটা সময় কথা বলেছেন বাংলা ভাষায়। বাঙালিয়ানার ছাপটা তার চরিত্রের সর্বত্র- নিজের হাতে রান্না করেন, তার রান্নার প্রশংসা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাদৃত। ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের বড় ভক্ত তিনি, অবসরে বাদ্যযন্ত্র নিয়েও বসে পড়েন কখনও। কে বলবে, নোবেলজয়ী এই মানুষটাকে একটা সময়ে খুনের মামলার আসামী হতে হয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মাথায় নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিল, জেলখানায় সহ্য করতে হয়েছিল অত্যাচার! অভিজিৎ নিজে প্রসঙ্গটা না তুললে বোধহয় এই কথাটা কেউ বিশ্বাসই করতো না কোনদিন!