অভিষেক যতো যাই করুন, অমিতাভের চেয়ে ভালো করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্ত সবাই তার মধ্যে অমিতাভ বচ্চনকেই খুঁজে ফিরেছে, বারবার তাকে অমিতাভের সঙ্গে তুলনা দেয়া হয়েছে; অভিষেক বচ্চনকে কেউ চায়নি আসলে...

সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম তার। বলিউডের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতার একমাত্র ছেলে তিনি, উত্তরসূরী হিসেবে বাবার রেখে যাওয়া জায়গাটা একসময় তিনি দখল করবেন, বাবার মতো তিনিও লম্বা সময় ধরে রাজত্ব করবেন ভারতের সিনেমাজগতে, এরকম ভাবনা কেউ ভেবেছিলেন কিনা কে জানে! কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিতে দেড়যুগ কাটিয়ে ফেলার পরেও পায়ের তলায় মাটি খুঁজে ফিরছেন অভিষেক বচ্চন। তার অনেক পরে যাত্রা শুরু করেও কতজন সুপারস্টার হয়ে গেল, অথচ বাবার নামের ছায়া থেকে বেরুতে পারলেন না তিনি।

কেন যে তাকে বলিউডের দর্শকেরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি, সেটাও একটা রহস্য বটে!  প্রত্যাখ্যানটা একদম শুরু থেকেই তার সঙ্গী। ২০০০ সালে জেপি দত্তের রিফিউজি সিনেমা দিয়ে রূপালী পর্দায় তার আগমন, নায়িকা ছিলেন কারিনা কাপুর। দুজনেরই ডেব্যু হয়েছিল এই সিনেমা দিয়ে। আর প্রথম সিনেমাতেই অভিষেকের কপালে ডিজাস্টারের তিলক লাগিয়ে দিয়েছিল বক্স অফিস। 

অথচ অভিষেক-কারিনা দুজনের অভিনয়ই প্রশংসিত হয়েছিল! চলচ্চিত্র সমালোচক তরন আদর্শ অভিষেকের অভিনয় নিয়ে লিখেছিলেন- "দারুণ একজন অভিনেতা হবার সব গুণাবলিই আছে অভিষেকের মধ্যে। অভিনয়ের ব্যাপারে ওদের যে পারিবারিক আবহ, সেটাকে অনেকদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে অভিষেকের মধ্যে..." 

বাবার ছায়া থেকে দর্শকেরাই বেরুতে দেয়নি অভিষেককে

আঠারো বছর পরে এসে বাস্তবতাটা সবাই জানেন। তরণের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়নি। দর্শকেরা অভিষেককে গ্রহণ করেননি সেভাবে, বরং বারবার ছুঁড়ে ফেলেছেন অবহেলায়। অভিষেক বচ্চনকে তার কীর্তিতে যতো মানুষ চেনে, তারচেয়ে বেশি মানুষ তার নাম জানে ঐশ্বরিয়ার স্বামী হিসেবে, আরও বেশি লোকে তাকে চেনে অমিতাভ বচ্চনের ছেলে বলে। অথচ তিনি অভিনয় খারাপ করেন, এটা কেউ দাবী করেনি। বেশকিছু স্ক্রীপ্ট বাছাইতে হয়তো ভুল তার ছিল, সেটা তো শাহরুখ-সালমানেরাও অহরহ করেন। তার ভালো কাজগুলোও সেভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি অনেক সময়, মাঝেমধ্যে তো মনে হতো, অমিতাভের ছেলে হওয়াটাই অভিষেকের অপরাধ কিনা! 

অথচ ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই তিনি মনি রত্নমের সঙ্গে 'যুবা' করেছেন, ধুমে দারুণ অভিনয় করেছেন, সিনেমা জগতে পা রাখার প্রথম কয়ে বছরের মধ্যেই 'বান্টি অউর বাবলি' বা 'গুরু'র মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যেগুলো কিনা বক্স অফিস কিংবা ক্রিটিকস- দুই পক্ষকেই সন্তুষ্ট করেছিল। বাবার সঙ্গে তিনি 'সরকার' বা 'সরকার রাজ' করেছেন, ধুম সিরিজের পোস্টারবয় বনে গিয়েছেন, 'কাভি আলভিদা না কেহনা'র মতো রোমান্টিক সিনেমায় তিনি যেমন সাবলীল, তেমনই 'বোল বচ্চনে'র কমেডি রোলেও দুর্দান্ত। কিন্ত দিনশেষে সঙ্গী হয়েছে সেই পুরাতন আক্ষেপই। 

বাবা বিখ্যাত কেউ হলে তার সঙ্গে সন্তানদের তুলনা করা হবেই, এটা খুবই স্বাভাবিক। আর দুজন একই প্রফেশনের মানুষ হলে তো সেটা আরও বেশি হয়। শচীনের ছেলে শচীনের চেয়ে বড় ক্রিকেটার হলেন কিনা, সেটা নিয়ে যেমন গবেষণা হয় নিরন্তর, তেমনই অমিতাভের ছেলে অমিতাভকে ছাপিয়ে যেতে পারছেন কিনা, সেসব নিয়েও অজস্র কাটাছেঁড়া হয়েছে বছরের পর বছর ধরে।

বাবা-ছেলে: তখন, এখন

অভিষেক সবসনয়ই বাবাকে আইডল মেনে এসেছেন, নিজেকে অমিতাভের সমকক্ষ কখনও মনে করেননি, এমনকি বাবার মতো হতেও চাননি। কিন্ত তুলনা অব্যাহত ছিল। অভিষেক যতো যাই করুন, অমিতাভের চেয়ে ভালো করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না হয়তো। যতো বড় তারকাই হোন না কেন, বাবাকে ছাপিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব। দর্শকের তাকে রিজেক্ট করার এটাও একটা কারণ হতে পারে। সবাই তার মধ্যে অমিতাভ বচ্চনকে খুঁজে ফিরেছে, অভিষেক বচ্চনকে কেউ চায়নি আসলে। 

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বাবার নামের ছায়ায় তো ঢাকা পড়েছেনই, এরপরেও বারবার তিনি অপ্রধান হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। বোল বচ্চনে যেমন তিনি লিড হিরো নন, তেমনই দোস্তানাতে ভালো অভিনয় করলেও সেখানে জন অ্যাব্রাহামই ছিলেন আলোর কেন্দ্রবিন্দুতে। ধুমের প্রতিটা পর্বে তিনি আছেন, তবুও ধুম তার সিরিজ নয়, তিনি সেখানে গৌণ। হাউজফুল সিরিজ বা হ্যাপি নিউ ইয়ারের মতো অন্যান্য সিনেমাতেও বৃত্তের কেন্দ্র থেকে অনেকটা বাইরেই তার অবস্থান! বছর দুয়েক আগে মুক্তি পেয়েছিলো 'মনমর্জিয়া'। অনুরাগ কাশ্যপের পরিচালিত এই সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন অভিষেক, পেয়েছেন প্রশংসাও। কিন্ত এই সিনেমাটাও দর্শকেরা সেভাবে গ্রহণ করেননি, বক্স অফিসে সাফল্য হাতে ধরা দেয়নি অভিষেকের। আরও একবার দর্শকের প্রত্যাখ্যানের শিকার হতে হয়েছে তাকে। 

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে লুডো মুক্তি পেয়েছে, রাজকুমার রাও, পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতো অভিনেতারা ফিকে হয়ে গেছেন অভিষেকের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সামনে। তবু অভিষেক প্রাপ্য সম্মান, বা হাততালিটা পাচ্ছেন না। কারন তিনি যে অমিতাভ বচ্চনের মতো কিংবদন্তীর সন্তান! সবার প্রত্যাশা, তাকেও যে অমিতাভই হতে হবে!

তুলনা জিনিসটা কখনও হয়তো ভালো, তবে বেশিরভাগ সময়ই খারাপ। কতটা খারাপ, সেটা অভিষেক বচ্চনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। বাবার সঙ্গে ক্রমাগত তুলনাই তো তার ক্যারিয়ারটাকে স্থিতিশীল হতে দিলো না। কেউ বুঝতে চায়নি, অমিতাভ আর অভিষেক দুটো আলাদা মানুষ, দুজন দুই রকমের হতেই পারেন। কে জানে, অভিষেক বচ্চন যদি অমিতাভ বচ্চনের ছেলে না হয়ে অন্য কোন তারকার সন্তান হতেন, তাহলে হয়তো ক্যারিয়ারটা আরেকটু বিকশিত হতো, এত বেশি প্রশ্ন উঠতো না তাকে ঘিরে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা