নিজের টাকায় তিনি শ্রমিকদের জন্য নয়টা বিল্ডিং ভাড়া করে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছেন, আক্রান্ত শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষা থেক্ব শুরু করে চিকিৎসা- সবকিছু হয়েছে তার খরচে। অন্যরা যেখানে অর্ধেক বেতন দিয়েছে, সেখানে এই কারখানায় প্রতিটা শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে শতভাগ...

মানুষটার নাম এবিএম শামসুদ্দিন, পেশায় তিনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। হান্নান গ্রুপের মালিক এবং চেয়ারম্যান। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশে যারা করোনাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন, এই লোকটা সম্ভবত তাদের তালিকায় সবার ওপরের দিকেই থাকবেন। তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় অসম একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে। ক্যালেন্ডারের পাতায় আগস্ট শেষ হয়ে সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে গেছে, শামসুদ্দিনের লড়াইয়ের বয়সও হয়েছে চার মাসের বেশি। এবং এই পর্যায়ে এসে, করোনার বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করতে কারোরই বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকবে না, যারা তার গল্পটি জানেন। 

এপ্রিলের ২৬ তারিখে সরকারী সিদ্ধান্তে গার্মেন্টসগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর আগে আমরা দেখেছি, গার্মেন্টস খোলার কথা বলে, চাকরি কেড়ে নেয়ার হুমকি দেখিয়ে একাধিকবার গ্রামে থাকা শ্রমিকদের ঢাকায় আনা হয়েছে। একদিকে সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে পেটের দায়- জীবন আর জীবিকার মধ্যে দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল।নিম্নবিত্ত মানুষগুলো। গণপরিবহন বন্ধ তখন, অসহায় মানুষগুলো শুধুমাত্র চাকরি বাঁচাতে শত শত মাইল হেঁটে এসেছে, হাতে-কাঁধে ব্যাগ, কোলে শিশু সন্তানকে নিয়ে। তবুও সময়মতো কাজে যোগ দিতে না পারায় অনেকের চাকরি যাওয়ার খবর আমরা গণমাধ্যমে পেয়েছি। 

গার্মেন্টস মালিকদের অনেকেই তখন স্বার্থপরতার পরকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। ন্যুন্যতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই অজস্র কারখানা চালু হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বা শ্রমিকদের কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ মানা হয়নি। বরং কেউ কেউ বলেছেন, গরীব মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেম ভালো, করোনায় তাদের কিছু হবে না! অবশ্য, যে দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা পুড়ে মরে গেলে কিছু হয় না, রানা প্লাজা ধ্বসে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেলেও কিছু হয় না, সেখানে করোনাভাইরাস যে পাত্তা পাবে না, তা তো বলাই বাহুল্য! 

নিজের গার্মেন্টসে এবিএম শামসুদ্দিন

তবে এবিএম শামসুদ্দিন স্বার্থপর হবার পথে হাঁটেননি। পঁয়ষট্টি বছর বয়স্ক এই মানুষটা গাজীপুরে তার কারখানার আশেপাশে নয়টা বিল্ডিং ভাড়া নিলেন, শ্রমিকদের মধ্যে যাদের করোনার উপসর্গ দেখা দেবে, তাদের কোয়ারেন্টাইন করার জন্য। হান্নান গ্রুপ বারো হাজার শ্রমিক কাজ করেন, তাদের মধ্যে মে ও জুন মাসে প্রায় ১৩৫৭ জন শ্রমিকের।করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপসর্গ দেখা দেয়া শ্রমিককে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে সেসব ভবনে। এই ১৩৫৭ জনের মধ্যে করোনা পজিটিভ হয়েছিলেন ১৪৩ জন। তাদের আলাদা আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। করোনা নেগেটিভ আসার আগে পর্যন্ত তারা কোম্পানীর খরচে আইসোলেশনে ছিলেন।

অন্যান্য গার্মেন্টসগুলো যেখানে কারো করোনা ধরা পড়লে তাকে ছুটিতে পাঠিয়েছে, বাড়ি চলে যেতে বলেছে, এবিএম শামসুদ্দিন সেটা করেননি। তিনি নিজের আপনজনের মতোই আগলে রেখেছেন তার কারখানার শ্রমিকদের। আক্রান্ত কেউ যেন বাড়ি আওয়ার পথে আরও দশজনের শরীরে ভাইরাস ছড়াতে না পারে, সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। ছয়জন ডাক্তার আর ছয়জন নার্সের একটা টিম গড়ে দেয়া হয়েছিল, তারা সর্বক্ষণ দেখভাল করেছেন রোগীদের। 

বারো হাজার শ্রমিকের প্রত্যেকে পুরো বেতন পেয়েছেন, অন্য অনেক গার্মেন্টসেই ৪০-৫০ শতাংশ বেতন কেটে নেয়ার কথা শোনা গেছে অর্ডার কম, বা কাজ কম হয়েছে এরকম অজুহাতে। এমনকি যারা করোনা পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে গিয়েছিলেন, ১৪/১৫ দিন কাজ করতে পারেননি, তারাও পুরো বেতনটা পেয়েছেন, সেইসঙ্গে দেয়া হয়েছে ঈদের বোনাসও। করোনাকালে সবাই যখন শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটেছে, এবিএম শামসুদ্দিন তখন উল্টো তার ফ্যাক্টরিতে ১৬০০ জন নতুন শ্রমিককে কাজে নিয়েছেন, মানে ১৬০০টি পরিবার সরাসরি উপকৃত হয়েছে! 

সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ চলছে এবিএম শামসুদ্দিনের গার্মেন্টসে

১৩৫৭ জন শ্রমিকের করোনা টেস্টের খরচও বহন করেছেন জনাব শামসুদ্দিন। তাদের আইসোলেশনে থাকার পুরো সময়টায় খাবার, ঔষধ সবকিছু তার খরচেই হয়েছে। এসবের পাশাপাশি নয়টা ভবনের ভাড়া, ডাক্তারের খরচ, সব মিলিয়ে গত চার মাসে শ্রমিকদের পেছনে খরচের অঙ্কটা প্রায় দুই কোটি ছুঁয়েছে। তবে সেই খরচ করতে কার্পণ্য করেননি এবিএম শামসুদ্দিন। শ্রমিকদের পরিশ্রমে, ঘামের দামে যে টাকা তিনি আয় করেছেন, সেটা খরচ করেছেন তাদেরই পেছনে, মালিক-শ্রমিকের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে একই পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছেন সবাই- এমন বিরল নজির দেখানো যাবে আরেকটা? 

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবিএম শামসুদ্দিনের বয়স ছিল মাত্র পনেরো, বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে মেলাঘর চলে গিয়েছিলেন তিনি সেই বয়সেই, দুই নম্বর সেক্টরের মেজর হায়দারের কাছে নিয়েছিলেন দীক্ষা। সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধাটি যুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দিয়েছেন, কিন্ত লড়তে তো ভুলে যাননি। জীবনের এই পড়ন্তবেলায় এসে অনাকাঙ্ক্ষিত এই যুদ্ধে নিজের শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য সাতপাঁচ না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে।  একাত্তরে কিশোর শামসুদ্দিন ঘরে ফিরেছিলেন বিজয়ীর বেশে, ২০২০ সালে এই অতিমারীতেও তার বিজয়রথ অব্যহত থাকলো। তিনি জানান দিলেন, ব্যবসা করেও মহামানব হওয়া যায়, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, লাভ-লোকসানের ঊর্ধ্বে উঠে শ্রমিকদের নিজের পরিবারের সদস্যের মতোই ভালোবাসা যায়... 

ছবি কৃতজ্ঞতা- শফিকুল আলম

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা