আবু বকর, ক্ষমা করো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, ক্ষমা করো এই দেশকে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
স্বপ্ন ছিলো লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুটাবেন। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির নির্মম বলি হয়ে ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, আজকের দিনে প্রাণ দিতে হয় তাকে।
দিনটার কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। ভুলবো না ছেলেটার কথা। বাবা দিনমজুর আর ভাই মুদি দোকানদার। তাই করে সংসার চালিয়ে যা থাকে, তার সঙ্গে যুক্ত হয় মুরগির ডিম বিক্রির টাকাও। সেই অল্প কিছু টাকায় নিজে চলতে পারতেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র আবু বকর।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময় বাড়িতে গিয়ে কারও কৃষিখেতে কাজ করে, কারও বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাতেন। এত সংকটের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হচ্ছিলেন। স্বপ্ন ছিলো লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুটাবেন। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির নির্মম বলি হয়ে ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, আজকের দিনে প্রাণ দিতে হয় তাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবু বকর। সেদিন ওই হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এরপর পুলিশ আসে। চলতে থাকে মারামারি। এর মধ্যেই হঠাৎ একটি টিয়ারশেল। রাজনীতি থেকে আজীবন দূরে থাকা বকর মারা গেল ক্ষমতাসীনদের নোংরা রাজনীতিতে। আজ ওই ঘটনার ১০ বছর। অথচ জড়িত কারও শাস্তি হয়নি।
আবু বকরের মৃত্যুর সময় আমি প্রথম আলোর রিপোর্টার। ঘটনার পর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাই। বকরের বন্ধুবান্ধবসহ তার পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওই ঘটনা আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। পরদিন আমার নিউজের শিরোনাম ছিল, ঘামঝরা জীবন, রক্তে ভিজে শেষ। প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক শাহেদ ভাই পুরো ঘটনা শুনে, আমার নিউজটা পড়ে হৃদয় কাঁপানো শিরোনামটা দিয়েছিলেন।
১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের যে ঘটনাগুলো আজও আমার হৃদয় ছুঁয়ে আছে, বকরের ঘটনা তার একটা। সেদিনের ঘটনার পরপর এফ রহমান হলে আবু বকরের বন্ধুদের কাছ থেকে একটি নোটখাতা পেয়েছিলাম যেটি বকরের শরীরের রক্ত ভিজে গিয়েছিল। ওই খাতা দেখেই শিরোনামটা এসেছিল। সেই খাতায় ছয়টি প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল। এরপর লেখা শুধু ‘প্রশ্ন:’। কী ছিল সেই প্রশ্ন?
অনেক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। প্রতীকীভাবে হলেও কখনো কখনো মনে হয়েছে এই দেশের দলীয় ও ছাত্ররাজনীতিকেই হয়তো প্রশ্ন করে গেছেন বকর। হয়তো প্রশ্ন করে গেছেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যেখানে একজন সাধারণ ছাত্র লেখাপড়া করতে এসে জীবন হারায়। যেখানে হারিয়ে যায় একটি দরিদ্র পরিবারের সব স্বপ্ন। হয়তো আমাদের গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর এই দেশ নিয়ে প্রশ্ন করে গেছেন।
আমার মাথার মধ্যে প্রায়ই সেই প্রশ্ন খেলে। জানি না কবে এই প্রশ্ন থেকে মুক্তি মিলবে। আজকের সকালটায় শুধু তোমার কথা মনে পড়ছে বকর। পারলে ক্ষমা করো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এই দেশকে। আর ভালো থেকো পরপারে।