যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অথচ তাকে হত্যা করতেই উদ্যত হয়েছিলো এ দেশের মানুষ। কোনো কারণ ছাড়াই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো অবসরে। হত্যা করা হয় তাঁর স্ত্রীকেও। এগুলো ছাড়াও তাঁর বঞ্চনার যে গল্পগুলো আছে, তা জানেন না অনেকেই!

মহামারীর প্রকোপে দেশ এমনিতেও ভালো নেই। এরমধ্যেই ক্রমাগত শুনছি, দেশের কৃতী সন্তানদের প্রয়াত হবার সংবাদ। এগারো দিনের মাথাতেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি এ দেশের দুই মুক্তিযোদ্ধাকে, দুই অভিভাবককে, যাদের শূন্যস্থান বাংলাদেশের পক্ষে মোচন করা সম্ভব না কোনোদিনই।  মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত প্রয়াত হয়েছেন গত ২৫শে আগস্ট। গতকাল প্রয়াত হলেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী। 

এই মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসলে অনেক আক্ষেপের গল্প কলমের ডগায় চলে আসবে। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন-কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! তাও সে অপছন্দের কাজটিই করছি এখন। হয়তো কিছু অপ্রিয় কথা উঠে আসবে। তাও মানুষের জানা উচিত এগুলো নিয়ে।  তিনি জন্ম নিয়েছিলেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে। বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। শিক্ষক বাবার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে একেবারে প্রথম বয়সেই পড়াশোনা নিয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠেন আবু ওসমান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যেও গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। অসুস্থতা ও আর্থিক কারণে ঢাকা কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় একটা কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর বিএ পাশ করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। এখানে পড়াশোনা করার সময়েই তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহন ছিলো তাঁর। এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৮ সালে কমিশন লাভ করেন, বারো বছর পরে মেজর র‌্যাঙ্কে প্রমোশন পান।।

সত্তরের নির্বাচনের পরে তখন টালমাটাল দেশ। আবু ওসমান চৌধুরী একরকম পাকাপাকিভাবেই ঢাকা চলে আসেন। ঢাকা থেকে যান বাংলাদেশের তৎকালীন রাজধানী চুয়াডাঙ্গায়। ৬ মার্চ তারিখে তিনি পদ্মা মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণ নামকরণ করে সে রণাঙ্গণের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন৷ বুঝতে পারছিলেন, সামনেই কিছু একটা অশুভ আসতে যাচ্ছে। সেজন্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জোরেসোরে। তাঁর অনুমান সত্যি হয়, ক্যালেন্ডারে আসে সেই ভয়াল কালোরাত; ২৫শে মার্চ। 'অপারেশন সার্চলাইট' এর সময়ে তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউজে। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে গনহত্যার কথা যখন তিনি জানতে পারেন, দিশেহারা হয়ে পড়েন। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। কোনোদিক থেকেই কোনো গাইডলাইন নেই। এরকম অতর্কিতে যে হামলা হবে, সেটি তো কারো মাথাতেই আসেনি মোটেও। কিছু না পেয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণই বারকয়েক শুনলেন। বুঝলেন, এটাই তাঁর জন্যে আদেশ। ২৬শে মার্চ সকালে বেলা ১১টায় তিনি চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং একদল সৈন্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। ২৭ মার্চ তাঁর বাহিনীর সাথে পাকিস্তানীদের একটা মুখোমুখি সংঘর্ষও হলো। সে সংঘর্ষে পাকিস্তানী এক ক্যাপ্টেন নিহত হন। এই ঘটনা তাকে ও তাঁর বাহিনীকে বেশ উদ্দীপ্ত করে। এরপর নিজের বাহিনীর সব সৈন্য ও স্থানীয় লোকজন, ইপিআরের গোলাবারুদ আর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানিদের উপর হামলার নেতৃত্ব দেন তিনি। চতুর্মুখী আক্রমণে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেন্টের দুই শতাধিক সৈন্য ও কমান্ডারদের বিশাল বহর ধ্বংস হয় এবং কুষ্টিয়াকে তিনি শত্রুমুক্ত করেন। 

আবু ওসমান চৌধুরী 

মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী সরকার গঠনের সময়েও ছিলো তাঁর উপস্থিতি। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে নবগঠিত মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণের পর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈনিক গার্ড-অব-অনার প্রদান করেন অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের'কে। এরপরই বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’। 

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন৷ তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন। মে মাসের দিকে জি এম এ জি ওসমানী এসে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগে ভাগ করেন। এবং দুটি সেক্টর করা হয়; ৮ ও ৯নং সেক্টর। ৮ নং সেক্টরের দায়িত্ব পান আবু ওসমান। ৮ নং সেক্টরের অধীনে ছিলো কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলা (যুদ্ধের পরবর্তীতে অবশ্য কিছু জেলা কে বাদ দেয়া হয়েছিলো এই সেক্টর থেকে)। এই পুরো সেক্টরের নেতৃত্ব দেন তিনি। আট নম্বর সেক্টরে যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর বাহিনী বেশ ক'টি সফল যুদ্ধও পরিচালনা করে। বিশাখালীর যুদ্ধ, লেবুতলার এ্যামবুশ, গোয়ালন্দ যুদ্ধ,  বেনাপোল যুদ্ধ, ভোমরা বাঁধ রক্ষায় আবু ওসমান চৌধুরী ও তাঁর বাহিনী অসাধারণ নৈপুণ্য দেখান। চৌকষ বাহিনীর সামনে টিকতেই পারেনি পাকিস্তানি হানাদারেরা। যুদ্ধকালে শুধু আবু ওসমান চৌধুরীর কথা বললে তথ্যে একটু ত্রুটি থেকে যাবে। আবু ওসমানের সহধর্মিনী নাজিয়া খানমও ছিলেন যুদ্ধের এক অংশ। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাহারা দিতেন তিনি। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে খাবার, ওষুধ সরবরাহ করতেন তিনি, তাঁর সাধ্যমত। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই যুদ্ধ করে গিয়েছেন সমানতালে, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে থেকে।

যুদ্ধ শেষের পর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন। ঐ পদে ৩ বছর চাকরি করেন তিনি। দেশকে ভালোবেসে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন যে মানুষটি,  ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থানের সময় সেই মানুষটিকেই হত্যার চেষ্টা করা হয়। তাঁর গুলশানের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও স্ত্রী নাজিয়া খানম, যিনি যুদ্ধকালীন সময়ে নিজেও যুদ্ধ করেছিলেন সমানতালে, নিহত হন। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এ বছরেরই ডিসেম্বরে  জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁকে সময় হওয়ার আগেই অবসরে পাঠিয়ে দেন

অবসরের সময়েও তিনি কাজ করে যান তার মতন। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানও। লিখেছেন বইও; এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম। যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন ঘটনা ও উপলব্ধিকে সংকলিত করা এ বইটি পেয়েছে  আলাওল সাহিত্য পুরস্কারও। এছাড়াও তাকে নিয়ে শর্টফিল্ম; He Fought for the Motherland নির্মাণ করা হয়েছিলো।

এই মানুষটি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। গত ত্রিশে আগস্ট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সিএমএইচে ভর্তি হন আবু ওসমান চৌধুরী। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন গতকাল। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইতি ঘটে যায় ইতিহাসেরই এক বড়সড় বর্নময় অধ্যায়ের। সে সাথে মনে চলে আসে কিছু যাবজ্জীবন আক্ষেপও। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। নিজের বাহিনী নিয়ে তিনি লড়েছেন একের পর এক লড়াই। সেই দেশটি স্বাধীন হওয়ার পরেই নিজের স্ত্রীকে হারান তিনি, এই দেশের মানুষের হাতেই। এই মানুষটিকেই কোনো কারণ ছাড়াই অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডারই কোনো না কোনো খেতাব পেয়েছেন, অথচ এই মানুষটিকে রাষ্ট্রীয় কোনো খেতাবও কোনোদিন দেওয়া হয় না। তাঁর দেওয়া চার কোটি সত্তর লাখ রুপি এবং ২৮ কেজি স্বর্ণ নিয়ে যুদ্ধের প্রথমদিকে দেশ চালান তাজউদ্দীন আহমেদ। সর্বাধিনায়ক  ওসমানী এই মানুষটিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেন, লজিস্টিকের দায়িত্বে বসান। এই ঘটনাগুলোতে আবু ওসমান চৌধুরীর আক্ষেপ ছিলো কী না, জানিনা। আক্ষেপ হওয়া উচিত আমাদের। দেশের সূর্যসন্তানদের ঠিকঠাক সম্মানও দিতে পারিনি। সম্মান বাদই দিলাম, তাদের নিয়ে আমরা কতটুকু বা জানি? জানার চেষ্টাও বা করেছি কবে? হয়তো পদ-পদবী-খেতাব এগুলো এই মানুষদের কখনো ভাবায় না। তবুও আমাদের দায়িত্বপালনে আমরা যে ব্যর্থ, সেটিই আসলে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। 

তিনি ওপারে ভালো থাকুন, এটাই প্রার্থনা। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো, কমান্ডার। 


*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা