স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির বরপুত্র আবজাল এখন কোথায়?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দুদকের এক কর্মকর্তা আবজালের দুর্নীতির খবর শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এই লোক কি সরকারী কর্মচারী, নাকি টাকা ছাপানোর মেশিন? সেই আবজাল গত দেড় বছর ধরে সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে নিজেকে!
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে চারপাশে, সাহেদ-সাবরিনারা ধরা পড়েছে, রাঘব বোয়াল টাইপের কর্মকর্তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে- এসবের ভীড়ে হঠাৎই মনে পড়লো, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই দুর্নীতিবাজ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন, একজন তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারী হয়েও যে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছিল- সেই দুর্নীতিবাজটার কি অবস্থা? কোন জেলখানায় বন্দী আছে সে? তার মামলারই বা অগ্রগতি কদ্দুর? খুঁজতে গিয়ে যেসব তথ্য পেলাম, তাতে মাননীয় স্পিকার হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না!
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিজের পদের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছিল আবজাল হোসেন। দুদকের হিসেবেই তার সম্পদের পরিমাণ ৫০০-৬০০ কোটি টাকা। আবজালের দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর মানুষ অবাক হয়ে ভেবেছে, এও কি সম্ভব! সরকারি সব ভাতা মিলিয়ে যার মাসিক আয় ত্রিশ হাজার টাকার কাছাকাছি, সেই লোক কোন আলাদীনের চেরাগ ঘষে এত টাকার মালিক হয়েছে, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। এর চেয়েও বেশি অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, আবজালের এই কীর্তি গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিলেও, এই দুর্নীতিবাজ বা তার স্ত্রী- কাউকেই এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ! দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও, এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছে এই কালপ্রিট।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তার। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৫টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেয় সে।
২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে আবজাল ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেয়। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হয়। পরে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ঢাকায় বদলি হয় সে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে আবজাল স্বাস্থ্য খাতের বড় একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলায়।
আবজাল হোসেনের স্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদফতরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ১৯৯৮ সালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। কিন্তু দুর্নীতির কারণে তার চাকরি চলে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে প্রতিযোগীতা হতে পারে, কে কার চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ এই নিয়ে। এমন মানিকজোড় সচরাচর দেখা যায় না। যাই।হোক, চাকরি হারানোর পরে আবজাল তার স্ত্রীকে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পেতে সে স্ত্রী রুবিনা খানমের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স করে।
গত দশ-বারো বছরে আবজাল স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং টেন্ডার কমিটির সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে এককভাবে শত শত কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিয়েছে। অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যাতে কাজ না পায় সেজন্য আবজাল নিজের স্ত্রী ছাড়াও তার ভাই ও শ্যালকের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে তাদের সর্বোচ্চ দরদাতা দেখিয়ে একচ্ছত্রভাবে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নেয়। এভাবে আবজাল কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এমনকি অনেক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই সে বিল তুলে নিয়েছিল। আবজালের মাসিক বেতন ছিল সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ সে ‘হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের’ গাড়ি ছাড়া চলাফেরা করতো না।
ওই দম্পতির সম্পদের লিস্ট তৈরী শুরু করলে সেটা শাহনামার চেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ঢাকার উত্তরায় তাদের পাঁচটি বাড়ি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি বাড়ি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট আছে। এর বাইরে দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। মোট সম্পত্তির পরিমাণ হাজার কোটি টাকার কম হবে না বলেই ধারণা। দুদকের এক কর্মকর্তা আবজালের এই বিশাল পরিমাণ দুর্নীতির খবর শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এই লোক কি সরকারী কর্মচারী, নাকি টাকা ছাপানোর মেশিন?
এবার আসা যাক আবজাল-কাহিনীর মোস্ট শকিং পার্টে। গত জানুয়ারীতে আবজালের দুর্নীতির খোঁজ পাওয়ার পর তাকে দুদকে তলব করা হয়। আবজাল দুদকে গিয়ে হাজিরাও দিয়েছিল। এরপরেই স্ত্রীকে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে সে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার কোন খোঁজই পায়নি গত দেড় বছর ধরে। যুগান্তরের দাবী অনুযায়ী, তদন্ত চলাকালেই নাকি সে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইটে করে দেশ ছেড়েছে, এর আগে নিজের কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রায় একশো কোটি টাকা তুলে নিয়েছে সে, সেগুলোকে ডলারে কনভার্ট করে চেপে বসেছে বিমানে। এদেশের মানুষ আর আইন ব্যবস্থাকে দেখিয়ে গেছে বৃদ্ধাঙ্গুলি।
দুদক অবশ্য আবজালের 'বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার' ব্যাপারটা মানতে রাজী নয়। তাদের দাবী, আবজাল দেশেই আছে, আত্মগোপনে আছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের পাসপোর্টই জব্দ করা হয়েছে, তাদের পক্ষে তাই বিদেশে পালানো সম্ভব নয়- এটাই দুদকের যুক্তি। তাহলে আমাদের পুলিশ-র্যাব কেন তাকে খুঁজে বের করতে পারছে না? কেউ কেউ দাবী করছেন তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এবছরও আবজালকে দেখেছেন, চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেও অধিদপ্তরে তার প্রভাব এখনও কমেনি- সেসবে বিশ্বাস না করেও আমরা প্রশ্ন করতে চাই, এত বড় লেভেলের একজন দুর্নীতিবাজ গত দেড় বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে কি করে? এই প্রশ্নের জবাব কি কেউ দেবেন?
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে