নির্মাতারা দারুণ দারুণ সব নাটক বানিয়ে গেলেই বা কী লাভ, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শক সস্তা, চটুল, স্থূল রুচির নাটকগুলো নিয়েই পড়ে থাকে, সেগুলোকেই ভিউয়ের দিক থেকে প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে রাখে?

বাংলা চলচ্চিত্রের মতো বাংলা নাটকের দর্শকও এখন মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একভাগে হলো শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, এলিট শ্রেণীর দর্শক। আরেক ভাগে হলো যে শ্রেণী অন্যকিছুর ধার ধারে না; বিনোদন ও সময় কাটানোই যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এখন যেহেতু ইউটিউব ভিউ'র মাধ্যমে বোঝা যায় কোন ধরনের দর্শক দেশে বেশি, তাই খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, শেষোক্ত ভাগেই রয়েছে বেশিরভাগ দর্শক। কারণ খুব ভালো মানের যে নাটকগুলো, যেগুলো দেখার পর আমরা ভূয়সী প্রশংসা করি, এমনকি আমি নিজেও মাঝেমধ্যে হাজার শব্দ ব্যয় করি সেগুলো নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে, সেসব নাটকের ভিউ বেশ কম। তথাকথিত হিট বা জনপ্রিয় নাটকের তুলনায় একদমই কম। 

আমি সবসময়ই মনে করি, বাংলা নাটকের সুদিন ফেরাতে গেলে সুনির্মাতাদের পাশাপাশি দর্শকদের দায়ও অনেক বেশি। কারণ নির্মাতারা দারুণ দারুণ সব নাটক বানিয়ে গেলেই বা কী লাভ, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শক সস্তা, চটুল, স্থূল রুচির নাটকগুলো নিয়েই পড়ে থাকে, সেগুলোকেই ভিউয়ের দিক থেকে প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে রাখে? কারণ, এখন যেহেতু সবজায়গাতেই বাণিজ্য হানা দিয়েছে, তাই প্রযোজকরা তো যে ধরনের বা যে নির্মাতাদের নাটকে ভিউ বেশি, তাদের উপরই বেশি অর্থলগ্নি করবে। তাই ভালো নির্মাতাদের ভালো কাজ আমাদের বেশি বেশি দেখা উচিৎ, সেগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ওয়ার্ড অভ মাউথ বাড়ানো, অর্থাৎ আরো বেশি মানুষকে দেখতে আগ্রহী করে তোলা উচিৎ। 

তবে শিক্ষিত শ্রেণীর দর্শকের এই কাজগুলোর পাশাপাশি আরেকটি দিকেও খেয়াল রাখা উচিৎ। সেটি হলো, আচরণে সংযত হওয়া। কারণ আচরণটাই তো সাধারণ, স্থূল রুচির দর্শকদের সাথে তাদের পার্থক্য গড়ে দেবে। সাধারণ দর্শক হয়তো ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে কিংবা ইউটিউবের কমেন্ট বক্সে বিপক্ষ মনোভাবের অধিকারীদেরকে গালাগালি দেবে, তাদের অপছন্দের নির্মাতা বা অভিনেতাদের নামে যাচ্ছেতাই বলবে। কিন্তু শিক্ষিত, রুচিশীল দর্শকদের থেকেও কি একই ধরনের আচরণ কাম্য? কখনোই না।

গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে মানহীন নাটকের

তারা তাদের দৃষ্টিতে বাজে কাজ যেগুলো, সেগুলোর সমালোচনা অবশ্যই করবে। কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক। ভদ্র ও সভ্য ভাষায়। অপমানজনক বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে নয়। কারণ শিক্ষিত, রুচিশীল মানুষের আচরণ কখনো এমন হতে পারে না৷ এ ধরনের আচরণের মাধ্যমে বরং নিজেদের নোংরা দিকটাই উন্মোচন করা হয়। এটাই বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, যতই তারা উন্নতমানের নাটক-সিনেমা দেখুন, তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব এখনো খুব বেশি উন্নত নয়। 

সুতরাং, যারা সত্যিই নিজেদের শিক্ষিত, রুচিশীল, বুদ্ধিজীবী মনে করেন, তাদের অবশ্যই অনলাইনের অশোভন রেষারেষি বা কাদা ছোঁড়াছুড়ি থেকে দূরে থাকা উচিৎ। তারা যদি আসলেই বাংলা নাটকের ভালো চান, তাহলে ওই সময়টার তারা সদ্ব্যবহার করতে পারেন ভালো কোনো নাটক কিংবা নির্মাতা বা অভিনেতা সম্পর্কে বিশ্লেষণধর্মী কিছু লিখে, যাতে করে তাদের লেখা থেকেই নতুন নতুন আগ্রহী দর্শকের জন্ম হয়, সর্বোপরি ভালো কাজগুলো আলোচনায় থাকে, সেগুলো তাদের প্রাপ্য মূল্যায়ন পায়। 

ভালো নাটকের প্রচারণার দায়িত্বটাও শিক্ষিত দর্শকের কাঁধেই বর্তায়

অপরদিকে তারা মন্দ, বাজে কাজগুলোরও প্রতিবাদ অবশ্যই করবেন। সেই প্রতিবাদটা হতে পারে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে, অর্থাৎ ওই কাজগুলো কেন মানসম্মত নয়, বাস্তবতার সাথে প্রাসঙ্গিক নয়, এবং কীভাবে ওই কাজগুলোকে আরো ভালো করা যেত কিংবা ওই কনসেপ্টের বদলে আর ভিন্ন কী কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করা যেতে পারত, এইসব আলোচনায়। 

এভাবেই দর্শক হিসেবে তারা যে উন্নত রুচি ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী, সেগুলোকে বাংলা নাটকের কল্যাণে তারা ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু তা না করে তারা যদি কেবল অনলাইনে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা আর আক্রমণাত্নক আচরণই দেখাতে থাকেন, তাহলে দিনশেষে না বাংলা নাটকের কোনো উন্নতি হবে, না বিশেষ শ্রেণীর নির্মাতারা তাদের নিম্নমানের নাটক বানানো থামাবেন৷

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা