রাজশাহীর এই পরিবারের ছয়জন মানুষের আঙুলে কোন ছাপ নেই। তাই তারা ভোটার আইডি কার্ড পাননি, পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সও মেলেনি। পদে পদে এমন বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে মানুষগুলোকে...

কয়দিন আগে একটা থ্রিলার বই পড়ছিলাম। কাহিনী অত আহামরি কিছু না। হতদরিদ্র এক লোক টাকার অভাবে বিত্তশালী এক ধনীর দুলালকে গলা টিপে হত্যা করে। পরে পুলিশ যখন দরিদ্র লোকটিকে গ্রেফতার করে, আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে, লোকটির হাতের আঙ্গুলে কোনো ছাপ নেই। প্রমাণের অভাবে দরিদ্র লোকটি খালাস পেয়ে যায়। থ্রিলার এখানেই শেষ। তখনই জেনেছিলাম, এই বিশেষ রোগটির কথা। যে রোগের কারণে আঙ্গুলের কোনো ছাপ থাকে না। রোগটির নাম বেশ খটোমটো। অ্যাডারমাটোগ্লিফিয়া। আবার এই রোগটিরই একটি অদ্ভুত নাম আছে- ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ।

অ্যাডারমাটোগ্লিফিয়া'তে আক্রান্ত রোগীদের হাতের আঙ্গুলে থাকেনা কোনো ছাপ! 

বিরল এই রোগটিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। এশিয়ার বাইরে চারটি পরিবারে এবং এশিয়ায় মাত্র একটি পরিবারে আছে এই রোগ। এশিয়ার যেই অঞ্চলে আছে এই বিশেষ রোগে আক্রান্ত পরিবার, সে পরিবারের বসবাস বাংলাদেশে!  রাজশাহীর পুঠিয়ায় এক পরিবারের ছয়জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এবং বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে যেখানে আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া একটা সীম কার্ডও পাওয়া যায় না, সেখানে তাদের বিপত্তি কতটুকু গভীর, তা বুঝতে আশা করি, শার্লক হোমস হতে হবে না।

আঙ্গুলের ছাপ না থাকার কারনে ভোটার আইডি কার্ড পেতে সমস্যা হয়েছে তাদের। পাসপোর্ট করতে সমস্যা হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স এখনো তারা পানইনি। এমনকী মোবাইলের সীম কিনতেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাদের। মোট কথা- যেখানেই বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন দরকার, সেখানেই বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা।

আবার রোগটি বিরল বলে অনেককে রোগটির সত্যতাও বিশ্বাস করানো যায় না। অনেকেই মনে করেন, এই মানুষগুলো শঠ। প্রতারক। মিথ্যে কথা বলে ফায়দা লুটতে চাচ্ছে। এই বিশেষ রোগে আক্রান্ত ছয়জন মানুষ তাই নানারকম বিড়ম্বনার পাশাপাশি মানসিক যন্ত্রণাও নেহায়েত কম ভোগ করেন না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগটি একটি বিশেষ রকমের জিনবাহিত রোগ। জিনের কিছু গড়মিলের কারনেই এই রোগটা হচ্ছে বলে অভিমত তাদের। এবং এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। সুইস বিমান বন্দরে এই রোগে আক্রান্ত এক রোগীকে পাওয়া গিয়েছিলো সর্বপ্রথম। তখন এই রোগের অদ্ভুত নামকরণ 'ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ' করা হয়েছিলো।

পৃথিবীতে আস্তে আস্তে সবকিছুতেই 'আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার' বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মানুষের নিরাপত্তার জন্যেই এটা দরকার। এরকম একটি সময়ে দাঁড়িয়ে রাজশাহীর পুঠিয়ার এই পরিবার যে সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন, তা বর্ণনাতীত। আঙ্গুলের ছাপ না থাকলে যদি বিদেশে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, এ কারনে এই পরিবারের সদস্যেরা বিদেশে যেতেও ভয় পাচ্ছেন। বংশ-পরম্পরায় তারা এ রোগ বহন করে এলেও পূর্বপুরুষেদের এ রোগ নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা ভোগ করতে হয় নি। প্রযুক্তি, বায়োমেট্রিক, আঙ্গুলের ছাপ...এ বিষয়গুলো আগের আমলে ছিলো না। তাই অনেকটাই বেঁচে গিয়েছেন তারা। কিন্তু বিস্তর ঝামেলায় পড়েছেন বর্তমান সদস্যেরা।

বিধাতা তাঁর খেয়ালখুশি মত মাঝেমধ্যেই অদ্ভুত কিছু রোগ দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠান। মানুষের যেসব বিশেষ রোগের বিড়ম্বনা হয়তো সারাজীবনেও যায় না। যেরকমটা আমরা লক্ষ্য করি, পুঠিয়ার এই পরিবারের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক আইডেন্টিটির পাশাপাশি রেটিনা আইডেন্টিটি যুক্ত হলে হয়তো তাদের এই যন্ত্রণা কমবে, কিন্তু তা হতে হতে কত বছর যে লাগবে, তা কেউ জানে না। তাই তাদের এই বিশেষ রোগ-সৃষ্ট বিড়ম্বনা কাটতে আর কত বছর লাগবে, প্রশ্ন সেখানেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে স্থির।

প্রযুক্তির কল্যান যে মানু্ষের জীবনে মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনাও ডেকে আনে, এই পরিবারই তার এক জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। এবং সে বিড়ম্বনা এখন হাড়েহাড়েই টের পাচ্ছেন তারা।

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা


*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা