মনে হতো কেউ ভালোবাসে না, বোঝে না, বিশ্বাস করে না...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বছর পেরিয়ে যখন চৌদ্দতে পা দিলাম, একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখলাম একটা ছেলে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখছে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো, হাজারো প্রশ্ন জন্ম নিলো। বুঝলাম, আমি ঠিক আগের মতো নেই!
কেউ বলে ১১/১২, কেউ বা ১৩/১৪। আসলে শৈশবের আড়মোড়া ভেঙে হুট করে কৈশোরে জেগে ওঠার নামই হলো বয়ঃসন্ধি। অস্থির, চঞ্চল, বল্গা হরিণের মতো দুরন্তপনা যেমন এ সময়ের বৈশিষ্ট্য তেমনি শান্ত দিঘীর মতো চুপচাপ হয়ে নিজের ভেতর গুটিয়ে যাওয়াও এর আরেকটা রূপ। সামাজিক, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে একজন কিশোর বা কিশোরী অনেক সময়েই বুঝে উঠতে পারে না তার কোনটি করা প্রয়োজন, কিংবা কেমন আচরণ এখন তাকে মানায়। মাঝেমাঝেই সে হয়ে ওঠে বিদ্রোহী, কখনো বা অতি আবেগী। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, 'তেরো বৎসর বয়সের মতো বালাই আর নেই।'
আমরা প্রত্যেকেই এই সময়টা পেরিয়ে আসি। আবার এই আমরাই এই বয়সের মানসিক পরিবর্তনের কথা ভুলে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উপর হম্বিতম্বি করি, তাদের অবস্থান বুঝতে চাই না। সম্ভবত প্রতিটা প্রজন্মই একই ধরনের আচরণ পায় তার অগ্রগামী প্রজন্মের থেকে। সামাজিকতার প্রেক্ষাপটে কিছুটা রকমফের থাকে। যেমন, আমাদের বাবা মায়েরা বয়ঃসন্ধি বিষয়টাই জানতেন না। বাবারা তখন খেলাধুলা বা পড়াশোনা করলেও মায়েদের বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়ে যেত সে বয়সে। আমাদের সময়ে এসে আমরা এই বিষয়ে অল্প স্বল্প জানলেও আমাদের বাবা মায়েরা সেসব বুঝতে চাইতেন না কিংবা বিষয়টা তাদের জন্যেও বোঝা কিছুটা দুষ্কর ছিল। ফলে, আচরণগত সমস্যা ধরতে না পেরে তারা রেগে যেতেন সহজেই।
আমি নব্বইয়ের দশকের মানুষ। প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার বিস্তৃতি দেখে বড় হয়েছি। অনেকটা শিল্প বিপ্লবের স্রোতে বড় হওয়া যাকে বলে। শৈশব সেই পুরোনো ধাঁচে কেটে গেলেও কৈশোরে ছিল প্রযুক্তির ছোঁয়া। ফলে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়টা কিছুটা প্রাচীন ও আধুনিকতার সমন্বয়ে কেটেছে। ঊনিশ শতকের ঢাকায় আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বছর পেরিয়ে যখন চৌদ্দতে পা দিলাম, একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখলাম একটা ছেলে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখছে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো, হাজারো প্রশ্ন জন্ম নিলো। বুঝলাম, আমি ঠিক আগের মতো নেই। নিজেকে খোলস ভাঙা প্রজাপতির মতো মনে হচ্ছিল। কেউ তো আগে অমন করে তাকিয়ে দেখেনি!
এফএম রেডিওর স্বর্ণযুগ বলা যায় সেই সময়কে। বাংলা গানের ধারা পরিবর্তন, রেডিওর অনুষ্ঠানের ধরন পরিবর্তন, সবটাই পেয়েছিলাম কৈশোরে। রেডিও জকির ভরাট ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠ শুনে কোন মেয়ে তাকে দেখার বাসনা পোষণ করেনি, সেটা খুবই কম ছিল। শুধু রেডিওর প্রোগ্রাম শুনব বলে ওয়াকম্যান সাইজের রেডিও কিনেছিলাম হেডফোনসহ, স্কুল টিফিনের টাকা জমিয়ে! টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় সেই হেডফোন কানে লাগিয়ে রেডিওতে গান শুনতে শুনতে যাওয়া বিরাট ভাবের বিষয় ছিল। ওটা যেন প্রকাশ করতো- দেখো! আমি বড় হয়ে গেছি।
ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যেস ছিল আমার। জীবনের রহস্যময় সময় অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে পড়েছি নানা রকম ইসলামিক বই, নবীদের জীবনী, সুফিবাদ সম্পর্কিত বই, হাদিস ইত্যাদি। তবে বইয়ের নীচে লুকিয়ে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা, কমিকস, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আর হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া মিস যেতো না। আম্মার হাতে কত যে মার খেয়েছি এসবের জন্যে! তবে এটাও সত্যি, আবেগের পরিবর্তনের সেই সময়টাতে আম্মা ভীষণ সাহায্য করেছেন, আস্থা দেখিয়েছেন। অকূল পাথারে পড়ে যাওয়া একজন কিশোরী, যার কাছে আচমকাই দুনিয়াটা অদ্ভুত লাগতে শুরু করেছে, তার কাছে একমাত্র চেনা আশ্রয়স্থল হিসেবে 'মা' নামক মানুষটি বাদে আর কেউ ছিলেন না। বাবা আজীবন রাশভারী মানুষ, তার সাথে খোলামেলা কথা বা সন্তানসুলভ স্নেহময় আচরণ প্রত্যাশা ছিল অনর্থক।
অকারণেই প্রচুর মন খারাপ হতো সে সময়। মনে হতো কেউ ভালোবাসে না, বোঝে না, বিশ্বাস করে না। নিজেকে খুব অকিঞ্চিতকর মনে হতো। ঘরের বাইরে উঠোনে রাতের বেলা বরই গাছের নীচে বসে পাতার ফাঁকে তারা ঝিলমিল করা আকাশ দেখতাম। পূর্ণিমা যেদিন থাকতো, সেদিন মন কেমন আনন্দে ভরে যেত। ১৫ দিন পর পর যে অমাবশ্যা-পূর্ণিমা হয়, সেটা আমি চাঁদ দেখে দেখে শিখেছিলাম। শুকতারা চিনতাম। সন্ধ্যে হলেই পশ্চিম আকাশে চেয়ে দেখতাম সে এসেছে কিনা। আরো পরিচিত ছিল এক লাইনে থাকা তিনটি তারা। নাম জানি না, কিন্তু আকাশ দেখতে বসলেই ওদের দেখতে পেতাম। মনে হতো কত পরিচিত, কত আপন!
বয়ঃসন্ধির সময় শারীরিক পরিবর্তনকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তখনো ফ্রক পরে বিকেলে খেলতে যাই। আম্মা দিলেন রাম ধমক। এখন থেকে সালোয়ার ও ওড়না ব্যবহার করতে হবে ফ্রকের সাথে। শরীর ঢেকে রাখতে হবে। খোলামেলা চলায় অভ্যস্ত আমি হঠাৎ যেন পোশাকের আবরণেই স্বস্তি পাওয়া শুরু করি। তার সাথে বাইরের লোকের কিছু কটুকথা ও দৃষ্টির নোংরামো আমাকে আরো গুটিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। ওই বয়েসেই বুঝেছিলাম, মেয়েদের জন্য কোন নিরাপদ জায়গা নেই। আস্তে আস্তে খেলার সাথী ছেলেগুলোও কেমন দূরত্ব বাড়িয়ে তুলল, আমিও ওদের সামনে যেতে লজ্জাবোধ করছিলাম। ধীরে ধীরে ঘরোয়া পরিবেশেই মানিয়ে নিলাম নিজেকে।
এখন যখন আমার ছোট ভাইবোনদের দেখি, বেশ অবাকই লাগে। ওরা নিজেদের অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। বয়ঃসন্ধি কী, এ সময় কী কী মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন হয়, কেন হয়, কী করা উচিত এসময়, সবটাই ওরা বেশ ভালো জানে। পরিবারও এখন বেশ বোঝার চেষ্টা করে তাদেরকে যেটা খুবই ইতিবাচক। বয়ঃসন্ধির সময়টায় অনেক মানসিক দ্বন্দ্ব আমি পেরিয়ে এলেও ভুলে যাইনি কিছু যন্ত্রণাকর মুহূর্তের কথা, যা একান্তই ব্যক্তিগত বলে এখানে লিখলাম না। তবে ওই ব্যথাটুকুর কথা মনে রেখেছি বলেই আমার অনুজদের আমি আপন করে নিই, ওদের ভালোবাসি, অস্থিরতার কারণ বুঝি ও সাহায্য করতে চেষ্টা করি। বিশ্বাস করি, ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা জয় করা যায়। কখনো কখনো অস্থির সময়কে সময়ের মতো বয়ে যেতে দিতে হয় যাতে ভবিষ্যতে ওই সময়টা আসা কেন প্রয়োজন ছিল তা বুঝতে পারা যায়। বয়ঃসন্ধি হলো ঠিক এমনি একটি সুন্দর সময়। প্রতিটি কিশোর কিশোরীর বয়ঃসন্ধি কাটুক আনন্দের মধ্য দিয়ে, সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে, ঠিক এমন স্বপ্নই আমি দেখি।
বয়ঃসন্ধি প্রতিটি মানুষের জীবনের খুব চমৎকার এক সন্ধিক্ষণ। বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক বিকাশের উপর একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের গঠন নির্ভর করে৷ বাড়িতে এই বয়েসী কিশোর-কিশোরী থাকলে তাদের সাথে ইতিবাচক কথা বলুন, আশার আলো দেখান, ভরসার জায়গা হয়ে উঠুন। তাতে আপনার হয়তো কিছু সময় ব্যয় হবে, কিন্তু একটা মানুষের পুরো জীবনটা পাল্টে যাবে!
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে