'পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই'- হুমায়ুন আহমেদের উক্তিটি নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিভেদে মতভেদ থাকবে হয়তো। কিন্তু আফগানিস্তানের এই পরিবারের জন্য যে উক্তিটি সত্য, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

'পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই'- হুমায়ুন আহমেদের উক্তিটি নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিভেদে মতভেদ থাকবে হয়তো। কিন্তু আফগানিস্তানের পক্তিকা প্রদেশের রাজধানী শারানায় বাস করা এক পরিবারের জন্য যে উক্তিটি সত্য, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাবা-মেয়ের ভালোবাসার মতো নির্ভেজাল আর নিখাদ ভালোবাসা যে হয় না, বাবারাই যে কন্যাদের জীবনের প্রথম হিরো, সেটাই প্রমাণ করেছেন শারানার সেই পরিবারের বাবা। নাম তার মিয়া খান।

কী এমন করেছেন তিনি? তবে শুনুন... রোজ তিনি বাইক চালিয়ে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন, শুধুমাত্র তার তিন কন্যাকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসার জন্য৷ শুধু তাই নয়, কন্যাদের ক্লাস চলাকালীন সময়, ৪ ঘন্টা তিনি বিদ্যালয়ের বাইরে অপেক্ষা করেন এবং আবারও ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কন্যাত্রয়কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এটি তার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে গেছে।

পাঠক পড়ে হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন- এ ঘটনাকে এত মহিমান্বিত করবার কী আছে! ১২ কিলোমিটার কী আর এমন পথ! এর চেয়েও বেশী পথ অতিক্রম করে পড়াশোনা করছে এ দেশেরই অজস্র শিক্ষার্থী। অনেক বাবাই তাঁর সন্তানদের এর চেয়েও বেশী দূরত্ব অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে নিয়ে যান।  

কিন্তু পাঠক, আবারও মনে করিয়ে দেই, দেশটির নাম আফগানিস্তান, আর এ কথা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয় যে আফগানিস্তানে নারীদের কেমন দৃষ্টিতে দেখা হয়। শিক্ষা তো দূর, এখনো লোকচক্ষুর আড়ালেই রাখা হয় এ দেশের নারীদের। এ রকম সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিজের মেয়েদের শিক্ষিত করতে বাবার এই পদক্ষেপ হৃদয়কে আদ্রই করে।

মিয়া খানের তিন কন্যা

যে বিদ্যালয়টিতে মিয়া খানের তিন কন্যা পড়াশোনা করছে, সেটি মূলত 'সুইডিশ কমিটি ফর আফগানিস্তান' নামে একটি এনজিও দ্বারা পরিচালিত। এনজিওটির ফেসবুক পেইজের মাধ্যমেই প্রথমে এই ঘটনাটি সবার নজরে আসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে৷ 'সুইডিশ কমিটি ফর আফগানিস্তান' এর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমেই মিয়া খান পরিবার সম্পর্কে প্রথম সবাই জানতে পারে এবং পরবর্তীতে মিয়া খানের ইন্টার্ভিউ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

এতটা পথ অতিক্রম করে প্রতিদিন মেয়েদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে মহত্বের সাথে দেখতে নারাজ মিয়া খান, তিনি পুরো ব্যাপারটিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখেন। তাঁর মতে, প্রত্যেক নারীরই শিক্ষা গ্রহণের অধিকার আছে এবং সে অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা উচিত নয়। নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে হলেও নারীশিক্ষা তাঁর কাছে জরুরী মনে হয়েছে। 

তাঁর এই উপলব্ধি হওয়ার পেছনে ছোট একটি গল্প আছে। একবার তাঁর স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, দূরে শহরে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার মতো সময় তাঁর হাতে ছিল না। স্থানীয় ডাক্তারের খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন তাদের এলাকায় কোনো মহিলা ডাক্তার নেই, সকলেই পুরুষ ডাক্তার! রক্ষনশীল মানসিকতা আর পর্দার কথা চিন্তা করে প্রথমে তাঁর স্ত্রী পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরবর্তীতে উপায়ন্তর না পায়ে ঠিকই চিকিৎসা নেন।

স্ত্রী সুস্থ হয়ে গেলেও ঘটনাটি দাগ কেটে দেয় মিয়া খানের মনে। সেদিনের পর থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন- নারীদের শিক্ষাদান করা আবশ্যিক একটি বিষয়, ভীষণ জরুরীও। এরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাঁর তিন কন্যাকে পড়াশোনা করাবেন, তিনি চান- তার কন্যারা পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করুক।

তিনি বলেন, 'আমি অশিক্ষিত এক দিনমজুর। তবু বুঝতে পেরেছি, শিক্ষার কত মূল্য। বিশেষ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখা খুব জরুরি। এতদিন এ বিষয়ে কেউ নজর দেয়নি বলেই তো এখানে একজনও মহিলা ডাক্তার নেই। আমার মেয়েদের আমি ছেলেদের মতো করেই শিক্ষিত করে তুলতে চাই, যাতে তারা সেই অভাব পূরণ করতে পারে। এটি আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন'।

পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে ভীষণ আনন্দিত তারা

এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই ধন্যি ধন্যি পড়ে গিয়েছে। মিয়া খানের উদ্যোগকে উৎসাহিত করে, তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে অনেকেই বিভিন্ন আর্টিকেল, লেখা পোস্ট করেছেন।

মিয়া খানের তিন কন্যার একজনের নাম রোজী। পড়াশোনা করতে পারার সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশি সে। তার ভাষায়, 'আমি পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে অনেক আনন্দিত। এখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছি। বাবা প্রতিদিন আমাদের বিদ্যালয়ে দিয়ে যায় এবং ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত বাইরে অপেক্ষা করে আবার বাড়িতে নিয়ে যায়। তার সহযোগিতা ছাড়া এত দূর থেকে আমাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না'।

আমাদের সমাজের যেসকল ফতোয়াবাজরা নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলেন, যেসকল বাবারা ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে সবসময় মেয়েদের পিছিয়ে রাখেন, তাদের জন্য মিয়া খান একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণই বটে! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা