আফ্রিদিকে ট্রল করার হাজারটা কারণ আছে। তার ডাক মারা, ব্যাটিং স্টাইল- এসব নিয়ে তুলোধোনা করা যায়। কিন্ত করোনার সময়ে যখন তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে ভাইরাসের কবলে পড়েছেন, তখন তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা অমানবিক আচরণ...

শহীদ আফ্রিদি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এই খবরটা শোনার পর দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একদল শোকের সাগরে ভাসছে, আরেকদল ব্যাঙ্গ করছে, টিটকারি মারছে। এই বঙ্গে আফ্রিদি তুমুল জনপ্রিয়, তার করোনায় আক্রান্ত হবার সংবাদে অনেকের হৃদয়েই কারবালার শোক নেমে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই। এরা পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ভাই ভাবে, মুক্তিযুদ্ধটা এদের কাছে ভারতীয় ষড়যন্ত্র, একটা গণ্ডগোল। এদের মধ্যে যারা একটু সাহসী, তারা বাংলাদেশে পাকিস্তান দল ক্রিকেট খেলতে এলে স্টেডিয়ামে গিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়, আর যারা একটু ভীতু  তারা ফেসবুকেই লাফালাফি করে। 

তবে এই লেখাটা বুকের ভেতর এক টুকরো পাকিস্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আফ্রিদি ভক্তদের উদ্দেশ্যে নয়। বরং তাদের জন্য, যারা আফ্রিদির করোনায় আক্রান্ত হবার সংবাদটা শুনে ট্রল করছেন, হাসির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। কারণ গতকাল থেকে সব দেখে, শুনে, জেনে এবং বুঝে মনে হয়েছে, এই একটা টপিকে আফ্রিদিকে ট্রল করাটা নোংরামির পর্যায়েই পড়ে। আফ্রিদিকে নিয়ে হাসাহাসি করার জন্যে হাহার হাজার বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্ত সেই তালিকায় 'করোনাভাইরাস' থাকবে না। 

কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ যখন ছড়ানো শুরু করেছে পাকিস্তানে, তখন অন্যান্য দেশের মতো সেখানেও লকডাউন জারী করা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তাব বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল। লকডাউন মানেই তো মানুষের পেটে খাবার নেই, কাজকারবার সব বন্ধ। সেই বিপদের সময়ে শহীদ আফ্রিদি এগিয়ে এসেছেন নিজের দেশের মানুষকে সাহায্য করতে। নিজের নামে গড়া দাতব্য প্রতিষ্ঠান 'শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন'কে কাজে লাগিয়েছেন এক্ষেত্রে।

শহীদ আফ্রিদী

পাকিস্তান বড়সড় দেশ, সব জায়গায় যে কাজ করা সম্ভব না তার একার পক্ষে, সেটা আফ্রিদি জানতেন। তাই নির্দিষ্ট কিছু জোন ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। স্পেশাল পারমিট জোগাড় করে ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন বেলিচুস্তানে। হ্যাঁ, সেই বেলুচিস্তান, যেখানকার মানুষ পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার জন্যে আন্দোলন করছেন অনেক বছর ধরেই। জাতি হিসেবেই পাকিস্তানে বেলুচদের ছোট করে দেখা হয়, একসময় পূর্ব বাংলার মানুষকে যেমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হতো। আফ্রিদি জানতেন, পাকিস্তানজুড়ে অনেকেই ত্রাণ বিতরণ করবেন। কিন্ত বেলুচিস্তানে খুব বেশি মানুষ ত্রাণ নিয়ে আসবেন না। তাই তো তিনি ছুটে গেছেন সেখানে। নিজের প্রায়োরিটি লিস্টে সবার ওপরে রেখেছেন বেলুচিস্তানকে। 

আফ্রিদিকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এত ঝুঁকি নিচ্ছেন তিনি। ক্রিকেটার আফ্রিদির কথাবার্তা কখনও পছন্দ হয়নি, তবে সেই উত্তরটা ভালো লেগেছিল। আফ্রিদি বলেছিলেন, "আমার এই কাজে যদি দুই চারটা মানুষের উপকার হয়, ক্ষতি কি- এটা ভেবেই কাজে নেমেছি। গোটা পাকিস্তানের সবাই যদি ঘরেই বসে থাকে, তাহলে যারা না খেয়ে আছে, তাদের পাশে কে দাঁড়াবে? আমরা তো এমন উন্নত দেশ নই যে এক মাস ধরে লকডাউন চললো, সবার ঘরে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে অটোমেটিক, সবাই ভালো থাকছে। ঘরে বসে থাকাটা খুব সহজ, ইন্টারনেট বা ফেসবুকে মতামত দেয়াটাও কঠিন কিছু না। কিন্ত সবাই যদি এটাই করে, তাহলে মানুষের পাশে কে দাঁড়াবে?" 

মুশফিকুর রহিম তার ডাবল সেঞ্চুরী হাঁকানো ব্যাটটা নিলামে তুলেছিলেন করোনায় দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য। সেই ব্যাট ১৭ লাখ টাকা দামে কিনে নিয়েছে আফ্রিদির ফাউন্ডেশন। ত্রাণ বিতরণে নিজে উপস্থিত থেকেছেন। এসব করতে গিয়েই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল আফ্রিদি নিজেই জানিয়েছেন সেই তথ্য, করোনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ এসেছে তার। 

শহীদ আফ্রিদি

যাদের ধমনিতে, শিরায় আফ্রিদি বাস করে, তাদেরকে গোনায় ধরছি না। এদের হিসেব করে লাভও নেই। কিন্ত যারা সেন্সিবল মানুষ, তারা বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে এমন ইস্যুতে আফ্রিদিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে নামলে প্রতিক্রিয়াশীল আর প্রগতিশীল- এই দুই পক্ষের মধ্যে খুব একটা পার্থ্যক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আফ্রিদিকে পঁচানোর হাজারটা কারণ থাকতে পারে। তার ডাক মারা, ব্যাটিং স্টাইল, তার অর্জন- এসব নিয়ে তুলোধোনা করা যায়। কিন্ত করোনার সময়ে যখন তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে ভাইরাসের কবলে পড়েছেন, তখন তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা অমানবিক আচরণ। 

কিছুদিন আগের কথা। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে কথা বলেছিলেন আফ্রিদি, বলেছিলেন, মোদি সরকার কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। সেই মন্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছিলেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটারেরা, যুবরাজ সিং আফ্রিদির বন্ধু হয়েও তাকে ধুয়ে দিয়েছিলেন। সমালোচনা করেছিলেন সাবেক ক্রিকেটার এবং বর্তমান বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীরও। আফ্রিদির করোনায় আক্রান্ত হবার খবর শুনে সেই গম্ভীরই বলেছেন, 'আফ্রিদির সাথে আমার রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও, আমি চাই সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক।' গম্ভীর যেখানে এমন কথা বলছেন, সেখানে অকারণে আমাদের নোংরামি করাটা নিশ্চয়ই শোভা পায় না। 

শহীদ আফ্রিদিকে পছন্দ করার কোন কারণ নেই। তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন, এটুকুই যথেষ্ট তাকে ভালো না বাসার জন্য। তিনি শূন্য রানে আউট হলে সেটা নিয়ে হাসাহাসি করাই যায়। আজ আফ্রিদি কলার খোসায় পিছলে পড়ে গেলে আমরাই ট্রল করতাম, ব্যাটিংয়ের মতো হাঁটার সময়ও আফ্রিদি আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। কিন্ত অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে আফ্রিদি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন- এই ব্যপারটা নিয়ে ট্রল হওয়াটা নোংরামিরই শামিল। আমি আফ্রিদিকে পছন্দ করি না, আর আমি আফ্রিদিকে ঘৃণা করি- দুটো লাইনের মানে পুরোপুরি দুই রকম। বুকের ভেতর পাকিস্তান নিয়ে ঘোরা মানুষজনের মতো আফ্রিদিকে ভালোবাসার কোন দরকার নেই, তবে এমন ইস্যুগুলোতে অন্তত সেন্সিবল আচরণ তো আমরা করতেই পারি, তাই না?

আরো পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা