প্রতিদিন এদেশে শত শত আফরোজা স্বামী আর শ্বশুড়বাড়ির লোকেদের হাতে খুন হয়। এই সমাজে আফরোজারা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে না, পোকামাকড়ের মত টিকে থাকে। যখন ইচ্ছে হয় বাপ্পীরা তাদের পা দিয়ে পিষে ফেলে...
কক্সবাজারের আফরোজাকে নিয়ে লিখবো করেও কোনোভাবেই সময় বের করতে পারিনি। মেয়েটার ছবি বের করে দেখেছি কয়েক দফা। নিষ্পাপ শান্ত মুখ। এরকম মুখ কত যে আছে! একই রকম দেখতে। নিরীহ, বোকা, সংসারকেই সুখ ভাবা দুঃখী মেয়ের দল!
আফরোজার স্বামী বাপ্পী আফরোজাকে খুন করেছে। তারপর প্রচার করেছে আফরোজা পরকীয়া করে পালিয়ে গেছে। আফরোজা যে খুন হয়েছে সে ঘটনার সাক্ষী দিয়েছে আফরোজার খুনি স্বামীরই চার বছরের বাচ্চা মেয়ে। আফরোজা যার সৎ মা ছিল। বাচ্চাটাকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করছিল আফরোজা। খুনী বাপ্পী এর আগে দুইবার বিয়ে করেছে। সেই দুই বউকেও এত নির্যাতন করেছিল যে দুইজনই সংসার ছেড়ে চলে গেছে। একজন রেখে গিয়েছিল এই মেয়েটাকে। আফরোজাকে বিয়ে করে আনার পর এই মেয়েটার দেখাশুনা আফরোজাই করতো। সেই শিশু মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তার খুনী বাবা তার স্নেহময়ী সৎ মাকে হত্যা করে উঠোনের কোথায় পুঁতে রেখেছে।
সমাজে নারী নির্যাতন কী হারে বেড়েছে, তা কি আপনারা উপলব্ধি করতে পারেন? আমাকে কমাস আগে এক মেয়ে ফোন দিয়েছে। আরেকজনের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে যেন আমি তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি, কারণ আমি তাকে চিনি না বলে ম্যাসেজ দেখছিলাম না। তো সেই অপরিচিত মেয়ের সাথে দু ঘণ্টা কথা বলতে হয়েছে আমার। কেন জানেন? মেয়ের স্বামী পরকীয়া করে, মেয়েকে অমানুষিক মারে, প্রেগনেন্ট হলে অ্যাবরশন করিয়ে আনে। মেয়েটা স্বামীকে ছাড়তে চায়। কিন্তু পারে না। কারণ তার অনেক প্রেম, তাও না। বিষয়টা হল, সংসার ভাঙার কথা মনে হইলে তার নাকি হাত পা কাঁপে, মাথা ঘুরায়, সব অর্থহীন মনে হয়।
আমি তারে বললাম, এইসব হলে সংসারে থাকেন। ভাঙার দরকার কী! সে বলে, আপা, পরশু রাতে আমার গলা টিপে ধরে রাখছিল প্রায় তিন চার মিনিট। ভাবছিলাম ওইদিনই শেষ দিন। মরে যাচ্ছি। শেষ মুহুর্তে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিসি। কিন্তু তার বদলে লাঠি দিয়ে মারসে। ওর সাথে থাকলে যেকোন দিন খুন হয়ে যাবো আপা।
আমার পরিচিত, অতি পরিচিত এক উচ্চশিক্ষিত নারী তার জামাইকে ছাড়তে পারছেন না। জামাইয়ের বিরুদ্ধে অন্তত তিন জন মেয়ে তার কাছে অভিযোগ দিয়েছে, যারা তার জামাইয়ের দ্বারা অ্যাবিউজড। উনি নানান স্ক্রিনশট পেয়েছেন। জামাইও তাকে এখন ছাড়তে চায়। কিন্তু উনার আশা আরো কিছুদিন সংসার করবেন।
মেয়েরা সংসারের আশায় লাথি খায়। কারণ জন্মমাত্র তাকে শেখানো হয় তার জীবনের শেষ ও একমাত্র গতি হলো সংসার। একজন পুরুষের অধীনে একটা ঘরের ভেতরে কয়েকটা সন্তান নিয়ে থাকা। সেই থাকার ভেতরে প্রেম না থাকুক, ভালবাসা না থাকুক, বিশ্বাস না থাকুক, স্নেহ না থাকুক, শ্রদ্ধা সম্মান আস্থা নিরাপত্তা না থাকুক- তবু থেকে যেতে হবে। ওই পুরুষ দুই বেলা লাথি দিলেও সেই পা জোড়া আকড়ায়ে ধরে ঝুলে থাকতে হবে। ওই পুরুষের সন্তান ধারণ করতে হবে। ওই পুরুষের বিছানায় শরীর পেতে দিতে হবে। ওই পুরুষের জন্য রানতে বাড়তে হবে। সমস্ত লাথি ঝাটা জুতার বাড়ির পরেও যেকোন মূল্যে সংসার টিকানোটাই জরুরি।
কারণ ভালো মেয়েরা সংসার ভাঙে না। সতী নারীর একবারই বিয়ে হয়। আবার সংসার ভেঙে গেলে কই যাবে! লাথি জুতার পরও লোকটার দেয়া খাবার খাচ্ছে, মাথার উপরে ছাদ দিচ্ছে ওই লোকই, পরনের কাপড় দিচ্ছে, সমাজে স্থান দিচ্ছে। এই ছাদ কাপড় খাবার আর সমাজিক অবস্থান মেয়ে নিজে অর্জন করতে শেখে নাই। কল্পনাতেও আনে নাই। হতে পারে সে শিক্ষিত এমনকি আয় করতে সক্ষম, তবু সে মানসিকভাবে পুরুষে নির্ভরশীল। সংসার চেতনায় বিশ্বাসী, বিবাহতে মোক্ষলাভ হয় বলেই সে শিখে এসেছে। বিবাহহীন বা বিবাহ ভাঙা তার কাছে পাপ।
আসলে তার নিজের অস্তিত্বটাই তার কাছে পাপ। তাই পুরুষের মার সে গায়ে পড়ে খায়। অথচ এই মারধোর খেতে যে এনার্জিটা ব্যয় হয়, তার চেয়ে অনেক কম এনার্জি ব্যয় করেই সে নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারতো, আত্মবিশ্বাসী হতে পারতো। এরজন্য সমাজ আর পরিবারের সাথে হয়তো বিশাল ফাইট দেয়া লাগতো। কিন্তু দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করে অর্ধমৃত হয়ে থেকে একদিন খুনী স্বামীর হাতে পূর্ণমৃত্যুর স্বাদ পেতে হত না।
আফরোজাকে খুন করছে তার স্বামী বাপ্পী আর তার পরিবার। প্রতিদিন এই দেশে শত শত আফরোজা শ্বশুড়বাড়ির হাতে খুন হয়। এই খুনটা কিন্তু একদিনে হয় না। আফরোজাদের জন্মের পর থেকেই খুনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের বেড়ে ওঠার ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকে সমাজের খুনের পরিকল্পনা। তাদের বেঁচে থাকার পুরো সময়টাই আসলে খুন হয়ে থাকা। কারণ এই সমাজে আফরোজারা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে না, পোকামাকড়ের মত টিকে থাকে। যখন ইচ্ছে হয় বাপ্পীরা তাদের পা দিয়ে পিষে ফেলে।
এই আফরোজাদের মুক্তি ঘটাবে কে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন