দিল্লির যে দূষণের কারণে আমরা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, সেই একই মাসে তার চেয়ে অনেক বেশি দূষণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম স্বয়ং ঢাকা শহরেই। বায়ুদূষণের কারণে দিল্লির কুখ্যাতি বেশ পুরোনো এবং এ শহরটিকে ভারতের ‘গ্যাস চেম্বার’ বলা হয়। সেই দিল্লিকেও আমরা ছাড়িয়ে গেলাম। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ।

গত নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। নভেম্বরের ৩ তারিখ দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচকে ঘিরে এ আলোচনা এতটাই জমে উঠেছিল যে, বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর কাছেও ক্রিকেটের চেয়ে দিল্লির বায়ুদূষণটাই বড় হয়ে উঠেছিল। এমনকি অতিরিক্ত বায়ুদূষণের কারণে ম্যাচটা আদৌ মাঠে গড়াবে কিনা, সেই প্রশ্নও সামনে চলে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হয়েছিল এবং ভারতের মাটিতে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ ইতিহাস রচনা করেছিল। 

নভেম্বর মাসে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠককে এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে, দিল্লির যে দূষণের কারণে আমরা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, সেই একই মাসে তার চেয়ে অনেক বেশি দূষণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম স্বয়ং ঢাকা শহরেই। বায়ুদূষণের কারণে দিল্লির কুখ্যাতি বেশ পুরোনো এবং এ শহরটিকে ভারতের ‘গ্যাস চেম্বার’ বলা হয়। সেই দিল্লিকেও আমরা ছাড়িয়ে গেলাম। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ।

বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুসারে, শুধু নভেম্বর মাসেই বায়ুদূষণের দিক থকে অন্তত তিনবার শীর্ষে উঠে আসে ঢাকা। ১৯ নভেম্বর দিল্লিকে হটিয়ে প্রথমবার শীর্ষে ওঠার পর ২৪ ও ২৬ নভেম্বরও ঢাকা ছিল শীর্ষে। তবে গবেষকদের বরাতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, নভেম্বর মাসের অন্তত আট দিন ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।

বছরের শুরুর দিকেও বায়ুদূষণ আলোচনায় উঠে এসেছিল। চলতি বছরের ৫ মার্চ গ্রিনপিস ও এয়ার  ভিজুয়ালের করা একটি যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় বায়ুদূষিত নগরী এবং বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত দেশ। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গড় বায়ুমান সূচক ধরা হয়েছিল ৯৭.১, আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের স্কোর ছিল ৭৪.২৭, তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের স্কোর ছিল ৭২.৫৪। সবচেয়ে কম স্কোর ছিল আইসল্যান্ডের, ৫.০৫। সবচেয়ে কম দূষিত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৯২ পয়েন্ট বেশি! অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তা এ পার্থক্য থেকে আঁচ করা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই চিত্রের দেখা মেলে।

হ্যান্ডিমামা
জনসচেতনতায়: HandyMama

এর আগে জানুয়ারি মাসে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ১৫ দিন ধরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা নির্ণয় করেছিল। এই ১৫ দিনের একটি মুহূর্তও ঢাকার বায়ুমান সূচক (একিউআই) সবুজতো ছিলোই না, বরং বেশিরভাগ সময় ছিল বেগুনী, মানে অতিরিক্ত অস্বাস্থ্যকর।

সাম্প্রতিককালে ঢাকার বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২৪ নভেম্বর। সেদিন ঢাকার একিউআই ছিল ২৪২, যার অর্থ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। একই দিন ২১১, ১৯৮ ও ১৯৮ সূচক নিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে ছিল যথাক্রমে কলকাতা, লাহোর ও উলানবাটোর (মঙ্গোলিয়া)।

বাতাসে ভাসমান বস্তুকণাগুলোর মধ্যে যেগুলোর ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটার সেগুলোকে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ১০ শ্রেণী এবং যেগুলোর ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটার, সেগুলোকে পিএম ২.৫ শ্রেণীতে ভাগ করে প্রতি ঘণমিটারে এসব বস্তুকণা কত মাইক্রোগ্রাম আছে (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন), সে হিসেব করে বাতাসের একিউআই স্কোর বের করা হয়। এসব বস্তুকণা এতটাই ক্ষুদ্র যে, ৬০ টি বস্তকণা মিলে মানুষের একটি চুলের প্রস্থের সমান হয়।

একটি শহরের বাতাস কতটা শুদ্ধ কিংবা কতটা দূষিত, তা একিউআই সূচক থেকে নির্ণয় করা যায়। বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) ০-৫০ এর মধ্যে থাকার অর্থ হলো বাতাসের মান ‘ভালো’।  ৫১-১০০ স্কোরের অর্থ ‘মোটামুটি গ্রহণযোগ্য’। ১০১-১৫০ হলে দূষণ ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরা হয়। ১৫১-২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১-৩০০ স্কোরের অর্থ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং মানুষের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। স্কোর ২০০ পার হলে সাধারণত  শিশু ও বয়স্কদের বাড়ির ভেতরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়, স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকে, নাগরিকদের মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়।

বর্ষায় বাতাসের মান কিছুটা ভালো থাকলেও শুষ্ক বা শীত আসতে আসতে বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে। নভেম্বর মাসের শুরু থেকে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকলেও ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে তা কয়েকদিন একটু সহনীয় মাত্রায় নেমে আসে। ১২ নভেম্বর থেকে তা আবার বাড়তে থাকে।

হ্যান্ডিমামা
জনসচেতনতায়: HandyMama

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ২০১৮ সালের ১৯৭ দিনই ঢাকার বায়ু ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ছিল! আর পুরো দেশের কথা বিবেচনায় নিলে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বায়ু ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল যথাক্রমে ১২৯, ১৪৫ ও ১৯৭ দিন। প্রখ্যাত জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে ঢাকায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতের বাতাস গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি ক্ষতিকর। বিভিন্ন রকম স্থাপনা নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল, গৃহস্থালি বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও কলকারখানার ধোঁয়া ও দূষিত পানি এর প্রধান কারণ।

কেন এত দূষণ?

ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ ঢাকার চারপাশের সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ। ২০১৩ সালে দেশে ইটভাটা ছিল ৪ হাজার ৯৮৫টি। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩টি, যাদের মধ্যে ২ হাজার ৫১৩টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। পরিবেশ ছাড়পত্র নেই মানে হলো এ ইটভাটাগুলো অবৈধ। আবার, ইটভাটায় জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণের যে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে, ২ হাজার ৮৩৭টি ইটভাটা সেই প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। এতে করে যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত জ্বালানীর ব্যবহারে পরিবেশে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

হ্যান্ডিমামা
জনসচেতনতায়: HandyMama

দেশের মোট ইটভাটার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই গড়ে উঠেছে ঢাকার চারপাশে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকার চারপাশে ২ হাজার ৮৭টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে এবং ঢাকার মোট বায়ুদূষণের ৫৮ ভাগ সরাসরি এসব ইটভাটা থেকে আসে।

ঢাকায় প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা যানবাহনের সংখ্যাও বায়ুদূষণকে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশ রোড এন্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুসারে, গত নয় বছরে ঢাকার যানবাহন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহন আছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০টি।

চলবে...

(ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে হ্যান্ডিমামার অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইনের প্রথম পর্ব এটি। আগামী পর্বগুলোতে বায়ুদূষণ মানুষের কী কী ক্ষতি করতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে এবং কীভাবে বায়ুদূষণকে মোকাবেলা করা যায়- সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।) 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা