কখনও ধর্মের নামে, কখনও নৈতিকতার নামে সবাইকে যখন এই পার্ভার্টেরা পঙ্গপালের মতো ঘিরে ধরে আক্রমণ করেছে, তখন আমরা চুপ ছিলাম, বরং এদের মন্তব্যের স্ক্রিনশট নিয়ে মজা করেছি, ব্যাপারটাকে রসিকতায় পরিণত করেছি, আজ সেসবেরই মাশুল দিতে হচ্ছে...
নিউইয়র্কে সূর্যমুখী ফুলের বাগানে মেয়ে আলাইনার একটা ছবি তুলে ইন্সটাগ্রামে শেয়ার দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। গাঢ় হলুদ রঙের ফুলগুলোর মাঝখানে দাঁড়ানো আলাইনাকেও মনে হচ্ছে ফুলের মতো সুন্দর। এমন চমৎকার একটা ছবি নিয়ে যে কেউ নোংরামির আসর বসাতে পারে, তা কল্পনাতেও ছিল না। কিন্ত সেটা এখন কঠিন বাস্তব। ফেসবুকে যখন বিভিন্ন অনলাইন পোর্টার বা ফেসবুক পেজ থেকে ছবিটা শেয়ার করা হয়েছে, তখন আলাইনার পেছনে থাকা সূর্যমুখীর বাগানটাকে 'পাটক্ষেত' আখ্যা দিয়ে সীমাহীন নোংরামিতে মত্ত হয়েছে কিছু অমানুষ।
আমাদের মানসিক বৈকল্য পতনের কোন স্তরে নেমে গেছে, তারই একটা জ্বলন্ত নিদর্শন হয়ে রইলো সাকিব কন্যার এই ছবির নিচে থাকা রগরগে মন্তব্যগুলো। এসব মন্তব্যকারীদের প্রোফাইলে গেলে কিন্ত অবাক হয়েই আপনি আবিস্কার করবেন, একটি অ্যাকাউন্টও কিন্ত ফেক নয়! এরা আমার-আপনার মতোই ছাপোষা মানুষ। কেউ ছাত্র, কেউ চাকরি করে, কেউ তো আবার মাদ্রাসার শিক্ষক! একই লোক হয়তো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, আল্লাহ'র কাছে ক্ষমা চায়, তারপর ফেসবুকে এসে সাকিব আল হাসানের বাচ্চা মেয়েটার ছবিতে বিশ্রি কমেন্ট করে- অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
কিংবা সেই লোকটার কথাই ধরা যাক, যে ফেসবুকে নিজের মেয়ের ছবি শেয়ার দিয়ে লিখেছে- 'আমার সুখ, আমার জান্নাত!' যার কাছে নিজের মেয়েটা সবকিছু, সেই বাবাও অন্যের তিন-চার বছর বয়সী মেয়েকে 'মাল' ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। তিনিও শামিল হন পাটক্ষেত সংক্রান্ত নোংরামিতে। একটা-দুইটা নয়, এরকম শত শত, হাজার হাজার নমুনা পাওয়া যাবে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, গালি বা নোংরা মন্তব্যের স্ক্রিনশট ভাইরাল হবার পরেও এরা মন্তব্য সরায়নি, অর্থাৎ এরা পাত্তাই দিচ্ছে না ব্যাপারটাকে!
আমরাও কি পাত্তা দিয়েছি? মোশাররফ করিম যখন 'ধর্ষণের জন্য নারীর পোষাক নয়, পুরুষের নোংরা মানসিকতাই দায়ী' বলে তৌহিদি জনতার তোপের মুখে পড়েছিলেন, তখন আমরা তো তার পাশে দাঁড়াইনি, চুপ ছিলাম। বেচারা মোশাররফ করিমকে প্রাণের ভয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, সত্যি কথা বলেও প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন নিজের মন্তব্য। আজ আলাইনার ছবিতে নোংরা মন্তব্য করা হয়েছে বলে আহাজারি করছে যারা, এদের অর্ধেককেই দেখবেন তাহসান-মিথিলা-সৃজিত ইস্যুতে রসালো মন্তব্য করেছে, তারাও এখন শামিল হচ্ছে প্রতিবাদে! একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হলে সেটা অপরাধ, আর পূর্ণবয়স্ক একজনকে করা হলে সেটা কি অপরাধ নয়?
এরা যখন মোশাররফ করিমকে গালি দিয়েছে,আমরা চুপ থেকেছি। যখন সাকিবের স্ত্রীকে পর্দা করার নসিহত দিয়েছে, আমরা পাত্তা দেইনি। ক্রিকেটার নাসিরের বোনের ছবিতে যখন দলবেঁধে আক্রমণ করেছে, তখনও আমরা গুরুত্ব দিতে চাইনি। মিথিলা থেকে জয়া আহসান, শবনম ফারিয়া কিংবা আয়মান সাদিক থেকে সালমান বিন রশিদ- সবাইকেই যখন এরা পঙ্গপালের মতো ঘিরে ধরে আক্রমণ করেছে, তখনও আমরা চুপ ছিলাম, বরং এদের মন্তব্যের স্ক্রিনশট নিয়ে মজা করেছি, ব্যাপারটাকে রসিকতায় পরিণত করেছি।
আজ আচমকা আলাইনার ঘটনায় আমাদের মনে হচ্ছে, আরে, ব্যাপারটা তো রসিকতার পর্যায়ে থাকছে না আর! আমরাই তো এদের পিঁপড়া থেকে ফ্র্যাংকেনস্টাইম হয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছি, সময় দিয়েছি। একে-তাকে গালি দিতে দিতে এই অমানুষের দল নিজেদের প্রবল প্রতাপশালী ভাবছে, তাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের কাছে সবাই নতজানু হয়ে যায়, সেলিব্রেটিরাও ক্ষমা চায়- এদের ক্ষমতা তো সীমাহীন! কারো কথা, কারো কাজ এদের পছন্দ না হলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণে, সেই আক্রমণ থেকে চার বছরের শিশুও বাদ যাচ্ছে না- এটা দেখে আমরা হাহুতাশ করছি! অথচ এই আফসোসটা আরও অনেক আগে করা উচিত ছিল আমাদের।
কণ্ঠশিল্পী প্রীতম হাসান কিছুদিন আগে একটা কথা বলেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গালিবাজদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া। এরা জানে গালির প্রতিবাদ কেউ করবে না, কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে না, মামলা-তদন্ত কিচ্ছু হবে না, তাই এরা বিপুল বিক্রমে নোংরামি করে। বাস্তব জীবনে যে ছেলেটা হয়তো জোরে ধমক খেয়ে প্যান্ট নোংরা করে ফেলে, সেও ফেসবুকে এসে বিশাল হনু সেজে এসব নোংরামিতে মত্ত হয়।
এই পার্ভার্ট লোকগুলোই দেখবেন ধর্ষণের পর নারীর পোষাক নিয়ে মন্তব্য করে, এরাই রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে টিজ করে, এরাই সুযোগ পেলে বাসের ভীড়ে নারী শরীরে হাত দেয়, এদের মধ্যে কেউই আত্মীয়-স্বজনের বাচ্চাকে একা পেলে কামনা চরিতার্থ করার জন্য যৌন নিপীড়ন করে- কারণ এরা নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শেখেনি, এদের চোখে নারী মানেই ভোগ্য পন্য, এর বেশি কিছু নয়। অথচ এরা কিন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, একেকজন বড় বড় ডিগ্রিধারী লোক, তবুও এরা মানবতার শিক্ষা পায়নি, সামাজিকতা আর নৈতিকতার প্রাথমিক পাঠটাও এদের মাথায় ঢোকেনি।
মন্তব্যগুলো এখনও আছে, আছে স্ক্রিনশট, নোংরা মন্তব্যকারীদের অ্যাকাউন্ট লিংক, তাদের ব্যাপারে তথ্যও। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি পারবে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এদের খুঁজে বের করতে, আইনের আওতায় আনতে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দ্যিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে, এই জায়গাটা থেকে এসব আবর্জনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করাটা খুব জরুরী। আমরা চাই, যে কোন ব্যক্তিকে নিয়ে ফেসবুকে কোন নোংরা মন্তব্য করার আগে বিকৃত মস্তিস্কের লোকগুলো অন্তরাত্মা যেন কেঁপে ওঠে শাস্তির কথা ভেবে। ফেসবুকটা ভাগাড়ে পরিণত হওয়া থেকে উদ্ধার করতে এই জায়গায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সাইবার ইউনিটের নজর দেয়াটা খুব জরুরী...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন