জীবনটা ছিল তার কাছে অ্যাডভেঞ্চার, ফিলিস্তিন-আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, জেল খেটেছেন, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বানিয়েছেন দুর্দান্ত সব সিনেমা, প্রামাণ্যচিত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মেধাবী এই পরিচালক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হারিয়ে গিয়েছেন অকালে, রেখে গেছেন একরাশ আক্ষেপ...
ধীরে বহে মেঘনা দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, সেটা থেমেছিল মহানায়ক দিয়ে। এক অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা মানুষটাকেই থামিয়ে দিয়েছিল এর তিন বছর পর। মাঝে তৈরী করেছিলেন সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে, মোহনা আর পরিণীতার মত ছবি। যতদূর জানি, মহানায়ক বাণিজ্যিক ভাবে সফল ছিল। বক্স অফিস বিহীন এই দেশে বাকীগুলোর খবর জানার চেষ্টা করে সফল না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, হয়েছেও তাই।
জীবনের প্রথমভাগ কাটিয়েছেন অনেকটা অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মত, ফিলিস্তিন আর আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছেন, কমিউনিজমের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন, সাংবাদিকতাও করেছেন। লন্ডনে গড়ে তুলেছিলেন ইষ্ট পাকিস্তান হাউজ এবং ইষ্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। এর মাঝেই পড়েছিলেন চলচ্চিত্রের প্রেমে। দেশে ফিরে সামরিক জান্তার রোষানলে পড়েছেন, জেল খেটেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজী বিভাগের প্রধান ছিলেন, একইসাথে দায়িত্ব পালন করেছেন নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও। তবে সিনেমার ভূত মাথা থেকে সরেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৈরী করেছিলেন লিবারেশন ফাইটার নামে একটি প্রামান্য চিত্র। সেই শুরু। এরপর আরো বেশ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরী করলেও ১৯৭৩ সালে ধীরে বহে মেঘনা দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
প্রথম ছবিটাই ছিল মাষ্টারপিস। অবশ্য ইউটিউবে খুজলে পাবেন না, মোহনা এবং পরিণীতাও আমি খুজে পাইনি। তাই আমার আলমগীর কবির দর্শন মূলত সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে আর মহানায়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ (ধীরে বহে মেঘনা ছোটবেলায় টিভিতে দেখেছিলাম, তখন জসিমের ডিশুয়াইক ছাড়া অন্য কিছু বোঝার বুদ্ধি আমার ছিল না, ব্যতিক্রমধর্মী এই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাটি আমার মাথায় তখন ঢোকেনি। বড় হয়ে একুশে টিভিতে আরেকবার দেখেছিলাম, তবে সিনেমা ঠিকমত বুঝতে শেখার পর এই ছবিটি আর খুজে পাইনি।)। একারণে আলমগীর কবিরকে আমি বিচার করব এই চারটি ছবির নিরিখেই।
নির্মাণ কিংবা গল্প বলার ঢংয়ে আলমগীর কবির এক নতুন ধারার সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, মেলোড্রামার ব্যবহার থেকে হয়তো পুরোপুরি বের হতে পারেননি, তবে সংলাপ বলার ঢংয়ে অনেকখানি বাস্তবতার মিশেল ছিল। জানি, অনেকেই আমার এই কথার সাথে হয়তো একমত হবে না, আমি হয়তো সেভাবে সিনেমার জনরা বিষেশজ্ঞও নই, তবে বাংলা সিনেমায় অনেকগুলো প্রথম কিন্ত আলমগীর কবিরের হাত ধরে এসেছে। যেমন, 'সীমানা পেরিয়ে'- কে আমি বাংলাদেশের প্রথম সারভাইভিং অ্যাডভেঞ্চারের তকমা দেব।
হাস্যকর শোনাচ্ছে? আচ্ছা বেশ, ভালমত প্রাণখুলে হেসে নিয়ে আমাকে বলুন, ৭০ এর সেই মহা প্রলঙ্করী ঝড়ের পটভূমিতে নির্মিত এই ছবিটির আগে কোন বাংলা ছবিতে নির্জন কোন দ্বীপে নায়ক-নায়িকার এভাবে আটকা পড়া দেখেছেন? উত্তর হবে, "না"। হ্যাঁ, সারভাইভালের চাইতে নায়ক-নায়িকার রোমান্স বেশি প্রাধাণ্য পেলেও, এই ধরণের প্লটের উপরে করা প্রথম বাংলা সিনেমা কিন্ত এটাই। একই সাথে এটা মুক্তিযুদ্ধের বাইরে প্রথম কোনো বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র।
একই ভাবে, সূর্য্যকন্যাকে বাংলা ছবির ইতিহাসে প্রথম আরবান কন্টেম্পোরারি ফ্যান্টাসি মুভির আখ্যা দেওয়া যায়। গ্রাম্য উপকথার উপর ভিত্তি করে বাংলা ছবিতো যুগে যুগে তৈরী হয়েছে। কিন্ত সমসাময়িক শহুরে জীবনধারাকে প্লট বানিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে অস্বাভাবিকতাকে ঢুকিয়ে দেওয়াটা কয়জনের সাধ্য হতে পারে? আজ আমরা নোলানের ইনসেপশন বা মেমেন্টো বা ইন্টারস্টেলার অথবা স্করসিসের শাটার আইল্যান্ডের শেষ দৃশ্যগুলো নিয়ে চুল ছিড়ি। আমি কখনও বলব না যে সূর্যকণ্যা উপরে উল্লেখিত ছবিগুলোর সমপর্যায়ের, তবুও কেউ কি আমাকে একটু এর শেষদৃশ্যের ব্যাখাটা দেবেন?
সবচাইতে উল্লেখজনক যে প্রথমের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, সেটা হল বাংলা সিনেমায় শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা নারী চরিত্রের ব্যবহার। মেয়েদের নিঃসঙ্কোচে সিগারেট টানতে দেখিয়েছেন, নিজের ইচ্ছায় বাধাহীনভাবে জীবনসঙ্গী বেছে নিতে শিখিয়েছেন এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সমাজের উচুতলাগুলো সভ্যতার সবসময়েই আসলে একই রকম ছিল। যুগগুলো শুধু সাদাকালো থেকে রঙীন হয়েছে, এর বেশিকিছু নয়। হাজার বছরের সেই পুরোনো রাত কেবল মন্ত মিয়াদের ঘরেই নেমে আসেনা, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের ঘরেও যুগে যুগে নেমে এসেছে এবং আসছে। এদের মধ্যেই কখনো কখনো লেলিনদের দেখা পাওয়া যায়, যারা হাজার বছরের রাতের সাহসী নিশাচর।
রুপালী সৈকতে-তে অনেকটা নিজের জীবনটাকেই বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আর মহানায়ক ছিল নিজের স্বপ্নের চরিত্রটার সেলুলয়েড অভিষেক (ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ আবার সূর্যকণ্যার "লেলিন" কে তার স্বপ্নের চরিত্র বলেন)। একজন মানুষ, যে জীবনের বাঁকে বাঁকে টিকে থাকার প্রয়োজনে ছুটে যেতে পারে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, বেছে নিতে পারে বোহেমিয়ান জীবন, কিন্ত মনের গহীণে সেও স্বপ্ন দেখে নিজের ছোট্ট একটা ঘরের, খুজে ফেরে ভালোবাসা। তিনি নিজেও কি তাই ছিলেন না? প্রথম স্ত্রী মঞ্জুরা বেগমের সাথে বিচ্ছেদের পর ১৯৭৫ সালে জয়শ্রী রায়কে বিয়ে করেছিলেন যে ভালোবাসার খোঁজে, তা কি পেয়েছিলেন? জয়শ্রী রায় জয়শ্রী কবির থেকে আবার জয়শ্রী রায়েই ফিরে গিয়েছিলেন, রেখে গিয়েছিলেন আলমগীর কবিরকে। তারপর ১৯৮৯ তে নগরবাড়ী ফেরি ঘাটে এক দূর্ঘটনায় নিভে যায় আরেকটি প্রাণ, যে মিছিলে পরে তারেক মাসুদ আর মিশুক মনিরের মতো আরো অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন।
এক নজরে আলমগীর কবির
জন্ম: ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৩৮
শিক্ষা জীবন: ম্যাট্রিকুলেশন: ১৯৫২ সাল, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। ইন্টারমিডিয়েট: ১৯৫৪ সাল, ঢাকা কলেজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলেন, তবে সেখানে পড়াশুনা শেষ করেছিলেন কিনা, এবিষয়ে কোন পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায়নি।
চলচ্চিত্র জীবন: শোনা যায়, ইংল্যান্ডে তিনি ইংগনমার বার্গম্যানের সেভেনথ সিল সিনেমাটির প্রেমে পড়েন এবং সেই থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন তাকে পেয়ে বসে। তিনি সর্বমোট ৯টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র: • লিবারেশন ফাইটার • প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ • কালচার ইন বাংলাদেশ • সুফিয়া, অমূল্য ধন • ভোর হলো দোর খোল • আমরা দুজন • এক সাগর রক্তের বিনিময • মনিকাঞ্চন • চোরাস্রোত
পূর্ণদৈর্ঘ্য্য চলচ্চিত্র • ধীরে বহে মেঘনা - (১৯৭৩) • সূর্য কন্যা - (১৯৭৫) • সীমানা পেরিয়ে - (১৯৭৭) • রূপালী সৈকতে - (১৯৭৯) • মোহনা - (১৯৮২) • পরিণীতা - (১৯৮৪) • মহানায়ক - (১৯৮৫)
সম্মাননা:
সিনে জার্নালিস্ট পুরস্কার - ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), জহির রায়হান উত্তরণ চলচ্চিত্র পুরস্কার - ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্য্যকন্যা (১৯৭৫), সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ পুরস্কার,
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: • বিজয়ী শ্রেষ্ঠ পরিচালক - সূর্য কন্যা (১৯৭৫) • বিজয়ী শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার - সূর্য কন্যা (১৯৭৫) • বিজয়ী শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার - সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) • বিজয়ী শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা - সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) • বিজয়ী শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র - পরিণীতা (১৯৮৬),
ডিপ্লোমা অফ মেরিট (মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, রাশিয়া) - মোহনা (১৯৮২), স্বাধীনতা পদক (মরোণোত্তর) - ২০১০
ব্যক্তিগত জীবন: ১৯৬৮ সালে প্রথম স্ত্রী মঞ্জুরা বেগমের সাথে পারিবারিক পছন্দে পরিণয়। ১৯৭৫ সালে বিচ্ছেদ এবং একই বছর অভিনেত্রী জয়শ্রী রায়ের সাথে প্রণয়ের সূত্রে পরিণয়। জয়শ্রী রায় টাইটেল পাল্টে জয়শ্রী কবির হয়ে যান। ১৯৮৫ সালে জয়শ্রী কবিরের সাথেও তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তিনি তিন কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক।
টুকরো তথ্য: ধীরে বহে মেঘনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৭২ সালে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পর আলমগীর কবির ছবিটি নির্মাণের দায়িত্ব নেন।
আলমগীর কবিরের ৭টি সিনেমার ৬টিতেই বুলবুল আহমেদ ছিলেন নায়কের চরিত্রে। ৪টি ছবিতে নায়িকার চরিত্রে ছিলেন জয়শ্রী কবির।
মৃত্যু: একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বগুড়া গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে নগরবাড়ী ফেরি ঘাটে এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় ২০ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখাটার শিরোনামে ফিরে আসি। কেন আলমগীর কবির একটি আক্ষেপের নাম? কারণ লুতুপুতু প্রেমকে উপজীব্য করে বানানো সিনেমাগুলোর ভীড়ে আমি একটি সীমানা পেরিয়েকে খুজে ফিরি, উদ্ভট ভিএফএক্সে ত্যাক্ত আমি আরেকটি সূর্য্যকণ্যার জন্য অপেক্ষা করি, আমি আরেকজন মহানায়কের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকি, যাদের গল্প কোন কল্পনা নয়; আমার আপনার, আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে নেয়া এবং যা শুধু কূপমুন্ডুকের মত আমাদের সমাজেই থেমে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
হ্যাঁ, এদেশে জহির রায়হান কিংবা হুমায়ুন আহমেদরা সিনেমা বানিয়েছেন, আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, চাষী নজরুল ইসলামরাও মাটি ও সমাজের গল্পকে তুলে ধরেছেন, তানভীর মোকাম্মেল বা তারেক মাসুদ অথবা হালের তৌকির আহমেদরাও আমাদের জীবনটাকেই সেলুলয়েডের আয়নায় তুলে ধরছেন। কিন্ত জীবনের প্রতিটি বাঁকে ঘটে চলা দমনগুলোর বিরুদ্ধে এভাবে রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন কয়জন? বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমার হিরোকে এইসব জীবনের গল্পে নিয়ে আসার সাহস দেখিয়েছেন কয়জন? এইজায়গাটাতেই আলমগীর কবির অনন্য। তাই জহির রায়হানের মত আলমগীর কবিরও ক্ষণজন্মা এক আক্ষেপের নাম, যার কাছে আরো অনেক কিছুই পাবার ছিল, কিন্ত পাওয়া হয়নি।
কৃতজ্ঞতা- বাংলা চলচ্চিত্র গ্রুপ
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন