কে এই অ্যালেক্সেই নাভালনি? কেন তিনি পুতিনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার নাম?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একযুগ ধরে অ্যালেক্সেই নাভালনি লিখে যাচ্ছিলেন সরকারবিরোধী একের পর এক কলাম। পুতিনকে প্রকাশ্যেই বলতেন- জোচ্চোর, অজস্রবার গিয়েছেন জেলে। নার্ভ গ্যাস প্রয়োগে মরতেও বসেছিলেন দুইবার। সম্প্রতি রাশিয়ায় ফেরামাত্রই আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে...
যারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে মোটামুটি একটু খবর-টবর রাখেন, তাদের কাছে অ্যালেক্সেই নাভালনি খুবই পরিচিত এক নাম। রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রকে এক হাত দেখে নিচ্ছে এই লোক। যত সময় যাচ্ছে, তাকে নিয়ে ততই জলঘোলা হচ্ছে। আর তাকে নিয়ে যতই জলঘোলা হচ্ছে, আখেরে লাভ হচ্ছে তারই। জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পুতিনের চকচকে কপালে বড়সড় এক ভাঁজ হিসেবেই ক্রমশ আবির্ভূত হচ্ছেন তিনি।
নাভালনি'র সবচেয়ে বড় পরিচয়- সে ভ্লাদিমার পুতিনের একনিষ্ঠ সমালোচক। সরকার পক্ষের দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার নিয়ে তিনি বরাবরই সরব। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি অনেকবারই হয়েছেন কারাগারের অতিথি। পুতিনের দলকে প্রকাশ্যেই বলেছেন 'চুরি ও জালিয়াতির আখড়া।' রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা, রাশিয়ার রক্ত শুষে নিচ্ছে... রাশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হওয়া এই মন্তব্যটিও তার। তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে অংশ নিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়৷ প্রার্থিতা বাতিল করার পেছনে পুতিনের কলকাঠি আছে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। এভাবেই, নানা, ঘটন-অঘটনের মিলিত জংশনে, সময়ের ফেরে নাভালনি'র বিশাল এক সমর্থকগোষ্ঠিও গড়ে উঠেছে রাশিয়াতে।
২০০৮ সাল থেকেই তিনি বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে তথ্যবহুল ব্লগ লেখা শুরু করেছিলেন। এই ব্লগ লেখার সুবাদে একদিকে যেমন তিনি কর্পোরেট হাউজগুলোর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম ক্রমশই তার ভক্ত হয়ে উঠছিলো। তিনি নানা অদ্ভুত ও বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতিতে বিভিন্ন সব কর্পোরেশনের হাঁড়ির খবর বের করতেন এবং সেগুলো নিয়ে লিখে লেখাগুলোকে ছড়িয়ে দিতেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লিখতে লিখতে যখন তিনি রাশিয়ায় বেশ পরিচিত এক মুখে পরিণত হয়েছেন, যখন তিনি প্রতিবাদের আলাদা এক শক্তিতেই পরিণত হয়েছেন, তখন তিনি 'বিগশট' প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফোকাস সরিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিবাদী লেখালেখি শুরু করলেন।
সরকার নিয়ে কথা বলে কে-ই বা কবে পার পেয়েছে? গনমাধ্যমে নাভালনিকে ব্যান করলো সরকার, তার বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ এনে তদন্তের তোড়ে তাকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো হতে লাগলো নিয়মিত। অজস্রবার কারাগারেও যেতে হলো তাকে। অজ্ঞাত আততায়ীরা নাভালনি'র মুখে অ্যান্টিসেপটিক সবুজ রঙ ছুড়ে মেরে হামলাও করলো সময়ে-অসময়ে। কিন্তু তাও নাভালনি থামলেন না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে মস্কোতে দিলেন বিক্ষোভের ডাক। তখন তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হলো। পরে জানা গেলো, কারাগারে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নাভালনি। কারাগার থেকেই তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে।
গল্পে টুইস্ট আসে তখনই। নাভালনি ক্রেমলিন প্যালেসের দিকে অভিযোগ তুললেন। বললেন, তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে পুতিনের নির্দেশে। এ বিষের কারণেই তীব্র অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। নাভালনি'র ব্যক্তিগত ডাক্তারও জানিয়েছেন, এরকম অদ্ভুত অ্যালার্জিতে নাভালনি কস্মিনকালেও ভোগেননি। তবে কী নাভালনির অভিযোগই ঠিক? এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে এখনো হচ্ছে জোরদার বিতর্ক।
এই বিষ- বিতর্ক অমীমাংসিত রেখেই তিনি জেল থেকে বেরোলেন। আবার শুরু করলেন আন্দোলন। গত বছরের আগস্টে বিমানে করে সাইবেরিয়া যাওয়ার সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানিতে। জানতে পারা যায়, 'নভিচক' নামের স্নায়ু বিকলকারী এক বিষ দেওয়া হয়েছিলো নাভালনি কে। এ বিষের ফলশ্রুতিতেই অসুস্থ হয়েছেন তিনি। নাভালনি জানালেন, এ কাজ পুতিন ও তাদের দোসররাই ঘটিয়েছে। কারণ, পুতিনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী এখন তিনিই। পুতিন ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ ঘটাবে এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
যাই হোক, এ ঘটনার পর পাঁচ মাস জার্মানিতে কাটিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন তিনি। বিমানে করে মস্কো ফিরছিলেন। সাথে নিয়েছিলেন একগাদা সাংবাদিককেও। যাতে করে পুতিন এখানে কোনো চাল খাটাতে না পারে। বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নাভালনি'র স্ত্রী ও হাজার হাজার সমর্থকেরা। মস্কো বিমানবন্দতে তারা জড়ো হয়েছিলেন নাভালনি কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। কিন্তু নাটক ঘটলো তখনই। বিমান আর মস্কো এয়ারপোর্টে নামলো না। পাইলট জানালেন, বিমানে কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ কথা বলার পরে বিমান নামে শেরমেতেইয়ভো এয়ারপোর্টে। সেখানে নামার পরেই গ্রেফতার করা হয় তাকে।
নাভালনি যে পুতিনের গলার বেশ বড়সড় কাঁটাতে পরিণত হয়েছে, সেটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। এবং নাভালনি ইস্যুকে কেন্দ্র করে পুতিনের জনপ্রিয়তাতে এসেছে ভাটা। আন্তর্জাতিকভাবেও তাকে চাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে নানাভাবে। নাভালনি'র এই গ্রেফতার-নাটককে কেন্দ্র করেই যেমন একাট্টা হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ইতালি বিক্ষোভ প্রকাশ করছে। এছাড়াও রাশিয়ার জনগণের এক বড়সড় অংশও ক্রমশ নাভালনির দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। পুতিনের গদি ক্রমশই যে নড়বড়ে হচ্ছে, সেটা বলাই বাহুল্য।
আনপ্রেডিক্টেবল পুতিন এবার কোন ম্যাজিক দেখিয়ে লাইমলাইটে আসবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন