নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, মিত্রবাহিনীর জেনারেল অরোরার কাছে কিছুক্ষণ আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন নিয়াজী। মৃত্যুকে জয় করে বেঁচে থাকা ঢাকাবাসী বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়; চলছে বিজয় মিছিল। মিছিলে পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা, সবুজ বাংলার বুকে যেন উদিত হয়েছে বিজয়ের লাল সূর্য। মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে হুটহাট চলে যাচ্ছে বন্দুক থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। আজ আনন্দের দিন, চব্বিশ বছরের শোষণ আর দুইশো পঁয়ষট্টি দিন রক্তের নদীতে সাঁতার কাটার প্রহর শেষ হয়েছে আজ!

মিছিল দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ছুটে যাচ্ছেন দুই মেয়ে নীপা আর শম্পাকে সাথে নিয়ে। খুঁজে বেড়াচ্ছেন একজন মানুষকে, যাঁর এই মিছিলগুলোর কোনোটায় সবার আগে থাকার কথা ছিল। সকালে বাসার ছাদে লাল সবুজের পতাকাটা ওড়ানোর কথা ছিল। জনতার এই ঢলে ভেসে যাওয়ার আশায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে উদগ্রীব ছিলেন যিনি। এই মিছিল দেখার অপেক্ষায় প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত কেটেছে তাঁর। অথচ হাজার হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছেন না শ্যামলী, নীপা, শম্পা। তিনি ডা. আলীম চৌধুরী; নীপা শম্পার বাবা, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর স্বামী। স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগের দিন বিকেলে যাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো আল বদর বাহিনীর রাজাকারেরা। 

স্বপরিবারে ডা. আলীম চৌধুরী
Courtesy: bdnews24

পনেরোই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটা কি পাঁচটা। দুই মেয়েকে নিয়ে পুরানা পল্টনের বাসার দোতলার বারান্দায় বসে ছিলেন ডা. আলীম চৌধুরী। মাথার উপরে গর্জন করে উড়ে বেড়াচ্ছে মিত্রবাহিনীর বিমান, বোমাবর্ষণ করছে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ করে, বিশেষ করে পিলখানায়। বিমানের শব্দে আলীম চৌধুরীর রক্ত টগবগ করে ওঠে। এবার যাবে কোথায় হানাদার বাহিনী? আর দু'দিনও টিকতে পারবে না এরা। স্বামীর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখতে পান শ্যামলী। অনেক দিন অনিশ্চতায়-আশঙ্কায় এই লোকটা হাসতে পারেননি। আজ তিনি নিশ্চিন্ত। হাসতে হাসতেই স্ত্রীকে বললেন, "দেখো, আর দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা স্বাধীন হয়ে যাব।" 

একটা গাড়ি এসে থামে গেটের সামনে; কাদা মাখানো একটা মাইক্রোবাস। স্ত্রীকে ভেতরে যেতে বলে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন আলীম চৌধুরী। কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির নীচের গেটে বেল বাজলো। অস্ত্র হাতে এসে দাঁড়ায় দুই আলবদর। আলীম চৌধুরীর বাসার নীচতলায় ভাড়া থাকতেন মওলানা মান্নান নামের এক ব্যক্তি, কেউ জানতো না তখন, এই লোক ছিল আলবদরের চর। সে'ই পাকিস্তানী চরদের জানিয়েছিল, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছেন আলীম চৌধুরী। মানুষটাকে তোলা হলো গাড়িতে। পরনের কাপড়টাও বদলে নেয়ার সুযোগ পাননি। এরপরের গন্তব্য মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, আল বদর বাহিনীর অস্থায়ী টর্চারক্যাম্পে। 

কিশোর বয়স থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন আলীম চৌধুরী। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট আন্দোলন সফল করার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা মেডিক্যালের মেধাবী ছাত্র। ৫২'র ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ, এ কারণে ১৯৫৩ সালে কারাবরণও করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৭১ সালে যখন দেশমাতৃকাকে হানাদারদের কবল থেকে উদ্ধারের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তখন পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে যেতে থাকলেন তিনি। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন স্থানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন, তুলা-ব্যান্ডেজ আর ঔষধ পাঠিয়ে সাহায্য করতেন গেরিলা যোদ্ধাদের। ছবি তোলা আর লেখালেখির শখ ছিলো লোকটার। শ্যামলী নাসরিনের সাথে বিয়েটাও ছিলো ভালোবাসার; ধর্ম আলাদা হলেও সেটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দুজনের মাঝে।

রাত জেগে এসব ভাবতে থাকেন শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী। ঘুম আসে না তাঁর। নির্ঘুম সারা রাত কেটে গেল। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন খুঁজেও আলীমের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউ তাঁকে স্বামীর খবর জানাতে পারলেন না। শ্যামলীর দিশেহারা হওয়ার অবস্থা। তবে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন তিনি। কারণ, তাঁকে ভেঙে পড়লে চলবে না। কাজের ছেলেদের পাঠিয়েছেন গেণ্ডারিয়ায় আলীম চৌধুরীর ছোটভাই আবদুল হাফিজ চৌধুরীর কাছে। ১৮ ডিসেম্বর হাফিজ গেলেন রায়েরবাজারে ইটাখোলা বদ্ধভূমিতে, সেখানে পাওয়া গেছে অনেকগুলো লাশ। সেখানেই বড় ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করলেন হাফিজ। রাজাকারেরা ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় পরনে থাকা শার্ট আর লুঙ্গি দেখেই চেনা গেল বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তিগত এই চিকিৎসককে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের পরনের লুঙ্গিটা উঠে ছিল হাঁটুর ওপরে। বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে ছিল বুলেটের আঘাতে, যে বুকে ছোট মেয়ে শম্পাকে জড়িয়ে ঘুমাতেন তিনি। হাত দু'টো পিছমোড়া করে বাঁধা, চোখ বাঁধার গামছাটা নেমে এসেছে গলায়; কোমরে আর কপালে বেয়নেট চার্জের দাগ। 

উদয়ন স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী আটচল্লিশ বছর পার করেছেন স্বামী হারানোর বেদনা বুকে চেপে। একটা চাপা কষ্ট সারাটা জীবন সঙ্গী হয়ে ছিল তাঁর, যে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাঁর স্বামী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন, জীবনটা উৎসর্গ করেছিলেন যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়, সেই স্বাধীনতা নিজের চোখে দেখে যেতে পারলেন না মানুষটা। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে বাবার দেখানো পথে হেঁটে দুই মেয়ে ফারজানা চৌধুরী নীপা আর নুজহাত চৌধুরী শম্পাও হয়েছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। শোকের অশ্রু চোখে রেখেই ডা. নূজহাত চৌধুরী দেখেছেন এই সবুজ বাংলার বুকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি কীভাবে ফিরে এসেছে, পূনর্বাসিত হয়েছে, তারপর তান্ডব নৃত্য চালিয়েছে বিপুল বিক্রমে। ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেছে, তাদের গাড়িতে উড়েছে লাল সবুজের পতাকা- যে পতাকার লাল বৃত্তে মিশে আছে তাঁদের বাবা শহীদ আলীম চৌধুরীর রক্তের ফোঁটা। 

ডা. নুজহাত চৌধুরী
courtesy: genocidemuseumbd

ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে বাবাকে আর কখনও জড়িয়ে ধরা হয়নি নুজহাতের, অন্য দশজনের মতো একশ'টা বায়না আর আবদার মেটানোর জন্যে তিনি বাবা নামের মহীরূহকে মাথার ওপর পাননি। বাবাকে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে কতগুলো বছর বেদনাকে সঙ্গী বানিয়েছেন নুজহাত চৌধুরী, শাওন মাহমুদ (শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা) কিংবা আরও শহীদের স্বজনেরা।

প্রতিবছর ক্যালেন্ডার ঘুরে ডিসেম্বর ফিরে আসে, শহীদেরা কেউ ফিরে আসেন না। আমরা সিজনাল দেশপ্রেমিক হয়ে যাই বছরের এই সময়টায়, কিন্ত প্রিয়জন হারানো এই মানুষগুলোর কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? আমরা বিজয় উদযাপন করি, শহীদদের রক্তে অর্জিত এই পবিত্র ভূমিতে বিচরণ করে বেড়াই অকৃতজ্ঞের মতো, বন্ধুত্ব পাতাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে। আর অপমানিত হন জীবন উৎসর্গকারী এই বীরেরা। অপমানিত হয় তাঁদের আত্নত্যাগ, বিফলে যায় তাঁদের স্বজনদের অশ্রুর ফোঁটাগুলো। এমন কোনো শীতের বিকেলেই, আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগে আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ আলীম চৌধুরী, শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারেরা। ফিরে আসেননি আর কখনও, আসবেনও না। তাঁদের রেখে যাওয়া রক্তস্নাত সবুজ বাংলায় পড়ে থাকি আমরা, তাঁদের স্বপ্নে দেখা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা