একজন মানুষ তার বাইক নিয়ে ছুটে বেড়ান দুর্গম রাস্তায়। সাথে থাকা রোগীটির জীবন বাঁচাতে নিয়ে যেতে হয় ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের হাসপাতালে। তবুও ছুঁটে চলেন তিনি...

মানুষটির নাম করিমুল হক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির ধলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। মালবাজারের চা বাগানের একজন সাধারণ কর্মী। নিজ গ্রাম ছাড়াও আশেপাশে আরো ২০টি গ্রামের বাসিন্দাদের নিজের বাইকে করে কোন টাকা পয়সা ছাড়াই হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের বেশি। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন এভাবেই। 

একজন মুসলমান হয়েও স্থানীয়দের কাছ থেকে দাদা খেতাব পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় মানুষজন ভালোবেসে তাকে এই নামে ভূষিত করেছেন। ‘অ্যাম্বুলেন্স দাদা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করা করিমুল হকের এই অর্জন কোনো অংশেই পদ্মশ্রীর চেয়ে কম নয় তার কাছে। চিকিৎসার অভাবে যারা মারা যেত, করিমুল হকের সহায়তায় তারা ফিরে পান নতুন জীবন। তার কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে  ইতিমধ্যেই পদ্মশ্রী খেতাব পেয়েছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের কুঁড়েঘর থেকে দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবন এর জার্নিটা নেহায়েত সহজ ছিলো না। সামান্য চা বাগানের একজন কর্মীর রাষ্ট্রপতির থেকে পদ্মশ্রী সম্মান নেয়া, চাট্টিখানি কথা নয়। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে পদ্মশ্রী জয় করেন তিনি। 

নিজের মাকে বাঁচানোর জন্য যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো, তখন প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করা করিমুল অ্যাম্বুল্যান্স তো দূরের কথা, একটি গাড়িও জোগাড় করতে পারেননি৷ তারপর থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, গাড়ির অভাবে হাসপাতাল পৌঁছতে না পেরে কাউকে যেন মরতে না হয়৷ যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নিজের অ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি নেই তো কি হয়েছে? মোটর সাইকেল তো রয়েছে। সেটাকেই অ্যাম্বুল্যান্স হিসাবে ব্যবহার করে দিনে বা রাতে প্রত্যন্ত এলাকার রোগীদের নিয়ে ছুটতে শুরু করলেন হাসপাতালে। তার এমন উদ্যোগ দেখে অনেকেই ঠাট্টা করতেন। কিন্তু এই কর্মকাণ্ডই তাকে পদ্মশ্রী সম্মান এনে দিয়েছে। 

এভাবেই ছুঁটে চলে অ্যাম্বুলেন্স দাদা করিমুল হক

‘‘আমি চাই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ বেশি করে আমার মতো এই কাজে এগিয়ে আসুন। যাতে করে কোনও রোগীকে চিকিৎসা না পেয়ে মরতে না হয়৷’’ এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেন অ্যাম্বুলেন্স দাদা করিমুল হক। 

তার এই জীবনকাহিনী নিয়ে ইতিমধ্যেই আত্মজীবনীমূলক বই লেখার প্রস্তুতি চলছে। মাঝে কথা উঠেছিলো তার জীবন নিয়ে বলিউডেও সিনেমা নির্মিত হবে। সেখানে নামকরা কোনো অভিনেতার অভিনয় করার গুঞ্জনও শোনা গিয়েছিলো। এদিকে অবশ্য করিম দাদা বলিউডের আশায় বসে নেই। তিনি নিজ উদ্যোগে একটি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। চাকরী করে যে কয়েক হাজার রুপি যা বেতন পান তার পুরোটাই খরচ করেন আর্ত মানবতার সেবায়। নিজের সহায় সম্বল বলতে তেমন কিছুই নেই। তার উপর দায়িত্ব নিয়েছেন একটি হাসপাতাল নির্মাণের। সাদা মনের মানুষগুলো তো এমনই হয়।  

২২ বছর ধরে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলেছেন তিনি। নিজে ভুগছেন চোখের সমস্যায়। প্রতিমাসে যে ইঞ্জেকশন নিতে হয় চোখে তার মূল্য ১২ হাজার রুপি। সেই অর্থ জোগাড় করতেও হিমিশিম খান। অথচ এই অবস্থাতেও অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পিছপা হচ্ছেন না। কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করলে তার প্রতি সুবিচার করা হবে সেটা জানি না। শুধু জানি, এই করিমুল হকেরা বেঁচে আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো মানুষের। জয় হোক এ মানবতার।   


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা