জানুয়ারীর মাঝামাঝিতে লেখা হয়ে গেল কবিতাটা, 'সব ইয়াদ রাখা যায়েগা' যেটার শিরোনাম। শুনে চমকে উঠলো মানুষ, উপমাবিহীন এমন নির্জলা সত্য অনেকদিন কবিতার আকারে কেউ লেখেনি যে!

আমির আজিজকে চিনি আরও অনেক আগে থেকে, যখন তার নামটা হয়তো জামিয়া মিলিয়ার বাইরে তেমন কেউই জানতো না। বামপন্থী ভাবধারার এই তরুণের লেখনীর ভক্ত হয়েছিলাম বছরখানেক আগে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন আগেই তার লেখা একটা কবিতা ভাইরাল হয়েছিল, বিজেপি সরকারের 'আচ্ছে দিন আয়েঙ্গে'-কে তুলোধোনা করে লিখেছিলেন ‘আচ্ছে দিন ব্লুজ’, সেটা চোখে পড়েছিল অনেকেরই। আমির আজিজের কণ্ঠস্বর সেই দফায় একবার নাড়া দিয়েছিল সবাইকে।

তবে আমির আজিজ বিখ্যাত হয়েছেন অল্প ক'দিন আগে। ভারতের অনেকেই তাকে এখন চেনে, রাস্তাঘাটে তরুণেরা দেখলে সেলফি তুলতে চায়, পিঠ চাপড়ে দেন প্রবীণদের কেউ কেউ। ইউটিউব শো'য়ের লম্বা সিরিয়াল পড়ে আছে, সাংবাদিকেরা ইন্টারভিউ চাইছেন, সেসবকে উপেক্ষা করে আমির ছুটে যান রাজনৈতিক জনসভায়, কানহাইয়া কুমারের পদযাত্রায় দেখা যায় তাকে, মাইক্রোফোনটাকে মুখের সামনে ধরে তিনি আবৃত্তি করেন বিখ্যাত সেই কবিতাটা- 'সব ইয়াদ রাখা যায়েগা...' যে কবিতা তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছে, দশজনের চোখে পরিচিত করে তুলেছে। 

বিহারের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল থেকে উঠে এসে নিজের যোগ্যতায় দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে ভর্তি হয়েছিলেন আমির, তার পরিবারের আর কোন সদস্যের জন্যে এটুকুই ছিল স্বপ্নের মতো। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল, তাদের ছেলে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে, টানাটানির সংসারে স্বচ্ছলতা আসবে। কিন্ত আমিরের মাথা জুড়ে ক্যারিয়ার নেই, সেখানে আছে কবিতা। হাতে গিটার, ঠোঁটে গান, গলায় সুর- নিজের লেখা, নিজেরই সুর করা। সেই গানে উঠে আসে শোষণ আর বঞ্চনার গল্প, বর্ণিত হয় সমাজের অব্যবস্থাপনার ইতিহাস। আমির আজিজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জামিয়া মিলিয়ার ক্যাম্পাসে, সেখানকার অতি পরিচিত মুখ তিনি। 

আমির আজিজ

গত ডিসেম্বরে মোদি সরকার জোর করেই পাশ করলো সিটিজেনশীপ অ্যামান্ডমেন্ট অ্যাক্ট, মুসলমান ছাড়া প্রতিবেশী তিন দেশ থেকে বাকী সব ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো। হাজার হাজার মানুষের সাথে আমির আজিজ রাস্তায় নামলেন, এজন্যে নয় যে তিনি মুসলমান। আমির আজিজ পথে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ এই আইনটা সেক্যুলার ভারতের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, ভারতকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রথম ধাপ। প্রতিটা আন্দোলন আর সংগ্রামে সবার আগে যিনি থেকেছেন, সেই মানুষটা এই আন্দোলনে থাকবেন না, তা তো হয় না!

জামিয়া মিলিয়ায় হামলা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে ছাত্রদের পেটালো অমিত শাহ'র পেটোয়া পুলিশ বাহিনী। সেই উত্তাল সময়ে কাঁধে গিটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমির আজিজ, মাথার মধ্যে জড়ো হতে থাকলো লাইন। জানুয়ারীর মাঝামাঝিতে লেখা হয়ে গেল কবিতাটা, 'সব ইয়াদ রাখা যায়েগা' যেটার শিরোনাম। শুনে চমকে উঠলো মানুষ, উপমাবিহীন এমন নির্জলা সত্য অনেকদিন কবিতার আকারে কেউ লেখেনি যে! 

তোমরা কালো পদ্ম লেখো
আমরা লিখব লাল গোলাপ
তোমরা জমিনে জুলুম লেখো
আকাশে লেখা হবে বিপ্লব
সব মনে রাখা হবে
সবকিছু মনে রাখা হবে, সব...

তোমাদের লাঠি গুলিতে নিহত হয়েছে আমাদের যে বন্ধুরা
তাঁদের স্মরণে হৃদয় বিরাণ করে রাখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব...

কালি দিয়ে তোমরা মিথ্যে লিখবে জানি
আমাদের রক্ত দিয়েই সই, সত্য নিশ্চয়ই লেখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব...

আমির আজিজ ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে গেলেন এই এক কবিতা দিয়েই। দিল্লি যখন জ্বলছে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে, তিনি তখন বেরিয়ে পড়েছেন নিজের এলাকায় তার কবিতাকে ছড়িয়ে দিতে। সুদূর লন্ডনে, যেখানে আমির কোনদিন যাননি, সেখানে এক পথসভায় তারই লেখা কবিতার ইংরেজী অনুবাদ আবৃত্তি করেছেন পিংক ফ্লয়েডের গিটারিস্ট রজার ওয়াটার! যে পিংক ফ্লয়েডের গান শুনে আমির বেড়ে উঠেছেন, বিষণ্ণ রাত কাটিয়েছেন, সেই ব্যান্ডের গিটারিস্টের কণ্ঠে নিজের লেখা কবিতা শুনে আমির কতটা আপ্লুত হয়েছেন, সেটা তিনিই ভালো জানেন। 

আমিরের কবিতা আবৃত্তি করেছেন রজার ওয়াটার

আধার কার্ডে তার নামটা লেখা আছে 'আমির আজিজ', মোদি-অমিত শাহ'র ভারতে এটাই তার জন্যে একটা বড় সমস্যা। নিজের শিক্ষাদীক্ষার ডিগ্রি তো আছে, কিন্ত বাবা বা দাদার ডিগ্রি চাইলে কি করবেন, সেটা আমির জানেন না। ভাড়া বাড়িতে থেকে এসেছেন বছরের পর বছর ধরে, জায়গা-জমির কাজগপত্রও নেই। নাগরিকপঞ্জি করা হলে তাতে বাদ পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে আমিরের পরিবারের, অথচ তারা শত শত বছর ধরে এই ভারতেই বাস করছেন, পাকিস্তান থেকে আসেননি, বাংলাদেশ থেকেও যাননি। অথচ তাদেরকেই ফেলে দেয়া হচ্ছে হুমকির মুখে! 

আমির তাই পথে নামেন, কণ্ঠস্বর প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তার। কবিতার লাইন হয়ে সেই প্রতিবাদ বেরোয় বুলেট হয়ে। একটা সময়ে সব প্রতিবাদ আর আন্দোলনে কবিরা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের জ্বালাময়ী কবিতাগুলো উজ্জীবিত করেছে আন্দোলনকারীদের। সেই চক্রটা থেমে গিয়েছিল অনেকদিন ধরেই। আমির আজিজদের হাত ধরে সেটা আবার ফিরে আসছে, বরুন গ্রোভারেরা লিখছেন 'হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে'র মতো কবিতা। আগামীর দিনগুলো কবিদের হবে - এমন বিশ্বাস রাখতে দোষ নেই কোন...


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা