অভিনেতা আমির খান আর পরিচালক রামগোপাল ভার্মার মতো ভয়াবহ রকমের জ্ঞানী মানুষও মাঝেমাঝে বড় ভুল করতে পারেন। আর এই ভুলের খেসারত দিতে হয় আমার-আপনার মতো বুভুক্ষু দর্শককে- এই দুইজনকে আর একসাথে কাজ করতে দেখতে না পেয়ে।

আমির ও রামু একসাথে একটি সিনেমাতেই কাজ করেছেন- রঙিলা। ১৯৯৫ সালে রিলিজ পাওয়া এই সিনেমার জন্য রামুর চয়েজ প্রথম থেকেই আমির ছিলেন, কিন্তু আমিরের শিডিউল কিছুতেই ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছিল না। একটা সময় রামু গোবিন্দকেও ভেবেছিলেন এই সিনেমার 'মুন্না' রোলের জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেননি। প্রায় দুই বছরের মতো রামু অপেক্ষা করেছিলেন আমিরের জন্য।

অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়েছিল। আমিরের খুব পছন্দ হয়েছিল সিনেমার স্ক্রিপ্ট। তবে শুটিংয়ের দিন যত যেতে লাগলো, আমিরের খুঁতখুঁতে স্বভাব কিছুটা বেড়ে গেল। স্ক্রিপ্টের কিছু ভুল আমিরের চোখে পড়ল। আমির এর আগে সিনেমার এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন, সে কারণে সিনেমার টেকনিক্যাল নলেজ তার বেশ ভাল ছিল। সিনেমার স্ক্রিপ্টে দুটো দুর্বলতা নজরে এসেছিল আমিরের-

১। মুন্না ক্যারেক্টার সারাক্ষণ কথা বলে, সবাইকে মাতিয়ে রাখে, মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে। এরকম একটা ক্যারেক্টার মিলিকে (উর্মিলা) শুধু 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' বলতে আটকাবে? জাস্ট এই একটা লাইন বলতে পারবে না সারাক্ষণ বকবক করা একটা যুবক?

২। সিনেমার প্রধান তিন ক্যারেক্টার- জ্যাকি, উর্মিলা, আমির- সবাই মনের দিক থেকে খুব ভাল। এদের বলতে গেলে কোন খারাপ দিক নেই। সবাই যার যার জায়গায় ঠিক আছে। এরকম তিনটা ক্যারেক্টার শুধু ভালোবাসার একটা লাইন বলার জন্য এতক্ষণ স্ক্রিনে থাকলে জিনিসটা বোরিং হয়ে যাবে কিনা?

আমির জাস্ট নিজের অবজার্ভেশন বলেছিলেন। সাথে এটাও বলেছিলেন রামুকে- কোন চেঞ্জ না এনেও আপনি যদি হুবহু আপনার স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কাজ করেন, আমার কোন আপত্তি নেই। এইসব পয়েন্ট আমার মনে খচখচ করছিল, তাই আমি ডিরেক্টর অর্থাৎ আপনাকে বলা প্রয়োজন মনে করেছি, বাকিটা আপনার মর্জি।

রামু নিজের মর্জিতেই চললেন। আমিরের সব কথা তিনি এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলেন। নিজের স্ক্রিপ্টে অটল থাকলেন। আমিরও বাধ্য ছেলের মতো নিজের সেরাটা দিলেন।

রঙিলা সিনেমায় আমির খান

সিনেমা রিলিজ হলো, সুপারহিট হলো সিনেমা। আমিরের অভিনয়ের দুর্দান্ত প্রশংসা হলো। মুন্না ক্যারেক্টারটা সবার পছন্দের ক্যারেক্টার হয়ে গেল। সিনেমা হিট হলে সিনেমার সাকসেস পার্টি হয়, এই সিনেমারও হলো। রামু সেই পার্টিতে আমিরের কাছে এসে বললেন, আপনার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, আপনার ধৈর্য্যের কোন তুলনা হয় না। জানিনা সামনে আপনার সাথে আর আমার কোন কাজ করা হবে কিনা, তবে আমি চাইব কাজ করতে। আমার এই সিনেমাতে আমি আপনার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি! আমির বিনয়ের সাথে সমস্ত প্রশংসা নিলেন।

সিনেমা রিলিজের পাঁচ বা ছয় মাস পরের কথা। এক সাংবাদিক রামুর ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন। হুট করে সাংবাদিক বললেন- এই সিনেমাতে আমিরের অভিনয় সবচেয়ে দুর্দান্ত, বাকিদের তেমন কিছুই করার ছিল না।

রামু কিছুতেই মেনে নিলেন না। সাথে সাথে বললেন- একদম না। উদাহরণস্বরুপ হোটেলে আমির আর উর্মিলার খেতে যাওয়ার সিনটা দেখেন। ঐখানে আমির আর উর্মিলা থাকার পরেও মানুষ সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছে ঐ ওয়েটারের এক্সপ্রেশনে। আমার মতে ঐ সিনে আমিরের চেয়ে বেটার এক্সপ্রেশন দিয়েছে ওয়েটার চরিত্রে অভিনয়কারী।

ইন্টারভিউ শেষ হলো। রামু তার পরের সিনেমার শুটিংয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তিনদিন পর সেই ইন্টারভিউ ছাপা হলো। হেডলাইন ছিল- 'রঙিলাতে আমিরের চেয়ে ওয়েটারের অভিনয় বেটার ছিল- বললেন রামগোপাল ভার্মা'

সাংবাদিকের এই চটুল আর মিসলিডিং হেডলাইন দেখে আমির স্বভাবতই প্রচন্ড রেগে গেলেন। রামুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু যুগটা তখন ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপের ছিল না। মোবাইল জিনিসটাই এভেলেবল হয়নি। তার উপর রামু শহরের বাইরে শুটিংয়ে ব্যস্ত। রামুকে না পেয়ে আমির ধরে দিলেন, রামু তাকে এভয়েড করার চেষ্টা করছেন। সাংবাদিকদের বললেন- রামু আসলে আমাকে প্রচন্ড হিংসা করেন, তাই এইসব বলেছেন।

কয়েকমাস পরে শহরে ফিরে রামু যখন দেখলেন সেই এক ইন্টারভিউ নিয়ে এই অবস্থা, তার তো মাথায় হাত! প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন তিনি, সবাইকে বুঝিয়ে বললেন তিনি কোন কনটেক্সটে সেই কথাটি বলেছিলেন আর অনেকে পুরো ইন্টারভিউ না পড়ে জাস্ট ঐ টাইটেল দেখেই ভুল ধারণা পোষণ করছিলেন।

পরিচালক রাম গোপাল ভার্মা

এর মাঝেই এক সাংবাদিক বলে বসলেন- কিন্তু আমির তো বলেছেন আপনি নাকি তাকে হিংসা করেন বলেই এভাবে কথাটি বলেছেন! রামু এবার আর পারলেন না। হাত জোড় করে বললেন- আমি আর আমিরের সাথে কাজ করব না। কারণ আমার আমিরের মতো পারফেকশন, কমিটমেন্ট আর ধৈর্য্য - কোনটাই নেই।

দুইজনের এই সম্পর্ক আর ঠিক হয়নি। অনেক বছর পর 'আপ কি আদালত' প্রোগ্রামে আমির খানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাংবাদিক রজত শর্মা- রামু বলেছিলেন তিনি নাকি কখনই আপনার সাথে আর কাজ করবেন না! আমির হাসতে হাসতে বলেছিলেন- তিনি আমার সাথে কাজ না করলে, এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না!

আজকাল যখন অনলাইন কিছু সস্তা পত্রিকায় মিসলিডিং টাইটেল দেখে আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি বা হাসাহাসি করি, তারা জেনে রাখুন- এই জিনিস আজ চালু হয়নি, এ অনেক পুরোনো জিনিস।

আরও জেনে রাখুন- আমির আর রামুর মতো ভয়াবহ রকমের জ্ঞানী মানুষও মাঝেমাঝে বড় ভুল করতে পারেন আর এই ভুলের খেসারত দিতে হয় আমার-আপনার মতো বুভুক্ষু দর্শককে- এই দুইজনকে আর একসাথে কাজ করতে দেখতে না পেয়ে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা