এই সিনেমা হয়তো এই সময়ে চলবে না, চালানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে না। মুক্তির প্রায় দুই যুগ পরে এসেও মানুষ সিনেমাটিকে মনে রাখতে বাধ্য হয়েছে। তারই স্মৃতিচারণ করা...

আম্মাজান, আম্মাজান, আপনি বড় মেহেরবান... গানটি শুনেনি এমন শ্রোতা খুব কমই আছেন। প্রয়াত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে গানটি গেয়ে সারাদেশে ঝড় তুলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। পরবর্তীতে অনেক সিনেমাতেই প্লেব্যাক করেছেন বাচ্চু ভাই, কিন্তু যে জনপ্রিয়তা এই গানটির মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছিলেন তার সাথে আর কোনকিছুরই তুলনা চলে না।

বলা হয়ে থাকে, প্রয়াত নায়ক মান্নার অনুরোধেই নাকি গানটিতে কন্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। আর তাতেই করেছেন বাজিমাত। অথচ নিয়তির নির্মম কী পরিহাস- এই ‘হৃদয়ছোঁয়া’ গানটি যিনি সুর করেছেন, যিনি গেয়েছেন এবং যিনি ঠোঁট মিলিয়েছেন প্রত্যেকেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই। আজকে তারা বেঁচে নেই, রয়ে গেছে তাদের কীর্তি।   

অ্যাভেঞ্জার্সের রাজত্বে আম্মাজান নিয়ে লিখতে বসেছি। বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসেসি যেমন বলেছেন মার্ভেলসের সিনেমা কোনো সিনেমাই না। তেমনি এই প্রজন্মও বলতে পারে আম্মাজান তো কোনো সিনেমাই না। এইটা নিয়ে এতো কথার কী আছে? যার জন্য খুব সহজেই বাতিলের তালিকায় পড়ে যেতে হবে। হোক না বাতিল, তাতে কী? আমাদের দেশের ঐ সময়ের সর্বোচ্চ আয় করা জনপ্রিয় সিনেমা আম্মাজান। বাংলাদেশের ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর তালিকা করলে আম্মাজানকে বাদ দেয়া যাবে না কোনোভাবেই। এখনো প্রায়ই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হতে দেখা যায়, এখনো মানুষের আবেগের সঙ্গে মিশে আছে এই সিনেমা। এখনো বাংলার পথে প্রান্তরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফেরে আম্মাজানের টাইটেল সং। 

আম্মাজান সিনেমার পোষ্টার 

সিনেমাটিতে আম্মাজানের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসায় ভেসেছিলেন চিত্রনায়ক মান্না। তার চরিত্রটির নাম ছিলো বাদশাহ। মা ভক্ত বাদশার পাগলামি এখনো চোখে ভাসে দর্শকদের। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলেছিলো, ভিড় ছিলো সিনেমাহলে, হয়েছিলো ব্যবসাসফল। তৈরি করেছিলো ইতিহাস। অনেক দর্শককে কাঁদতে কাঁদতে সিনেমাহল থেকে বের হতে দেখা গিয়েছিলো। এর মধ্যে অনেকে পরপর কয়েকবার সিনেমাটি দেখেছিলেন। সে সময়ে যারা সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমাটি দেখেছিলেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কি পরিমান ভিড় উপেক্ষা করে ব্ল্যাকের চড়া দামে দেখা লেগেছিলো। 

কিছু সিনেমা ইতিহাস তৈরি করবার পেছনেও থাকে ইতিহাস। বাংলা সিনেমার অন্যতম কান্ডারি কাজী হায়াৎ পরিচালিত আম্মাজান চলচ্চিত্রটি ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়। ৩৫ মিলিমিটার ফরম্যাটে ধারণকৃত এই চলচ্চিত্রের ষাটটি প্রিন্ট করা হয়েছিলো। চলচ্চিত্রটি নির্মাণে এক কোটি দুই লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। মুক্তির আগের দিন এই ছবির প্রযোজক প্রযোজনা ও সঙ্গীত সত্ব বিক্রি করে এক কোটি চার লাখ টাকা আয় করেন। অর্থাৎ, মুক্তির আগের দিনই চলচ্চিত্রটি দুই লাখ টাকা মুনাফা করে।

এটি প্রযোজনা করেছেন ও কাহিনী লিখেছেন মনোয়ার হোসেন ডিপজল এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন কাজী হায়াৎ নিজেই। এতে নাম ভূমিকায় (আম্মাজান) অভিনয় করেছেন শবনম এবং তার পুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মান্না। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী, আমিন খান, ডিপজল, মিজু আহমেদসহ অনেকেই। ২৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে কাজী হায়াৎ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন এবং ছবিটি বাচসাস পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও মান্নার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করে। 

পরিচালক কাজী হায়াৎ আম্মাজানের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শাবানাকে অনুরোধ করেছিলেন, শাবানা প্রথমে সম্মতি দিলেও পরে অভিনয় করেননি। তার বদলে শবনম আম্মাজানের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমার প্রযোজক ডিপজল প্রাথমিকভাবে মান্নাকে নিতে চাননি নিজেদের মধ্যে কোন্দল থাকার কারণে। পরবর্তীতে পরিচালক কাজী হায়াতের অনুরোধে মান্নাকে এই চলচ্চিত্রে নেয়া হয়। এছাড়াও হুমায়ূন ফরিদিকেও একটি চরিত্রের জন্য বিবেচনা করা হয়েছিলো, কিন্তু পরে তাকে আর নেয়া হয়নি।  

ফিরে আসি অভিনয় প্রসঙ্গে, পুরো সিনেমায় একাই রাজত্ব করেছেন নায়ক মান্না। আর এমন হৃদয়স্পর্শী মৌলিক কাহিনী লেখার জন্য ডিপজল অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এমন গল্প দেখেই হয়তো মান্না তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়টা করতে পেরেছেন এই সিনেমায়। এটিকে ডিপজল-কাজী হায়াত-মান্না ত্রয়ীর সেরা সিনেমাও বলা যায়।

এই আম্মাজান সিনেমা নিয়ে লিখতে বসলে অনেক কিছুই লেখা যায় আসলে, এটি যে নাইন্টিজের নস্টালজিক এলিমেন্টও বটে। কাজী হায়াত খুব সম্ভবত, তার সেরা কাজটি দেখিয়েছেন এই সিনেমার মাধ্যমে। আর তিনি ছিলেন বলেই নায়ক মান্নার কাছ থেকে অভিনয় জীবনের সেরা কাজটি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। এবং মান্নার অভিনয় দেখে মনে হয়েছিল সে যেন বাস্তব জীবনেরই বাদশা। তার জন্মই হয়েছে এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। শুধু মাত্র এই অভিনয়ের জন্য হলেও যুগ যুগ তাকে মনে রাখবে দর্শকেরা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা