সিনেমার প্রমোশনের জন্য যিনি স্ত্রীকে মাঝরাতে থানায় পাঠিয়ে নিজের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগে এফআইআর করাতে পারে- সেই লোক ধর্ষণের পেছনে নারীদের পোশাককে দায়ী করলে অবাক হবার কি আছে?
ধর্ষণের কারন হিসেবে নারীদের পোশাককে দায়ী করে সচেতন নাগরিকদের তোপেত মুখে আছেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং চলচ্চিত্রের নায়ক অনন্ত জলিল। তার এই বক্তব্যে অনেকেই অবাক হয়েছেন, কুরুচিপূর্ণ এই বক্তব্যের প্রতিবাদও করছেন। আমি বরং জলিল সাহেবের বক্তব্যে মানুষকে এভাবে অবাক হতে দেখেই অবাক হলাম। মিডিয়ার ফুটেজ পাওয়ার জন্য যে ব্যক্তি যে কোন কিছু করতে পারে, নিজের সিনেমার প্রমোশনের জন্য যিনি স্ত্রীকে মাঝরাতে থানায় পাঠিয়ে নিজের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগে এফআইআর করাতে পারে- সেই লোক ধর্ষণের পেছনে নারীদের পোশাককে দায়ী করলে অবাক হবার কি আছে? এটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা!
অনন্ত জলিল ঝানু ব্যবসায়ী। প্রতিটা জায়গায় তিনি প্রফিটটাই দেখেন। সর্বনিম্ন খরচে কিভাবে নিজের প্রমোশন করতে হয়, কিভাবে নিজেকে আলোচনায় নিয়ে আসতে হয়, সেটা এই বঙ্গদেশে তার চেয়ে ভালো খুব বেশি মানুষ জানেন বলে আমার মনে হয় না। কিছুদিন আগে হিরো আলমকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অগ্রীম দিয়ে একটা সিনেমার জন্য সাইন করিয়েছিলেন তিনি। পরে হিরো আলমের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ আসায় জলিলই আবার তাকে সিনেমা থেকে বাদ দেন, আর বলে দেন, এই টাকা ফেরত দিতে হবে না। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তখন মিডিয়াতে যে পরিমাণ আলোচনা হয়েছে, পঞ্চাশ লাখ টাকা খরচ করেও কেউ এত আলোচনার জন্ম দিতে পারে না। জলিল সাহেব সেটা পঞ্চাশ হাজার টাকায় করেছিলেন।
তার অতীত আমলনামা ঘেঁটে দেখলেই বুঝতে পারবেন, এই লোক সবসময় স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে, মেজরিটি যেদিকে, সেদিকেই ছিল তার অবস্থান। করোনাকালের গোড়ার দিকে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার জন্য আবেগী ভিডিও বানানোর কথাটাই মনে করে দেখুন, কিংবা আজকে ধর্ষণের সঙ্গে নারীর পোশাককে মেলানো, পোশাকের মধ্যে 'অশ্লীলতা' খুঁজে বের করার চেষ্টা সেটাকে ধর্ষণের কারন হিসেবে দায়ী করা- অনন্ত জলিল কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের বাইরে যাননি, স্রোতের বিপরীতে হাঁটার চেষ্টা করেননি।
ফুটেজ খাওয়ার লোভ তার আগেও ছিল, এখনও আছে। সেজন্যেই তিনি টাকা খরচ করে সিনেমা বানিয়েছেন, রিয়্যেলিটি শোয়ের আয়োজন করেছেন, এতিমখানায় দান করেছেন, অসহায় মানুষের দায়িত্ব নিয়েছেন, যদিও নানা সময়ে গণমাধ্যমে তার ঘোষিত সাহায্যগুলো মানুষ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ এসেছে, সেসব অভিযোগ আসার সাথে সাথেই তিনি ওই ব্যক্তি বা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলেছেন। দান বা সাহায্য যেটুকুই করে থাকুন না কেন, প্রচারণাটা তিনি ষোলো আনাই চালিয়েছেন সবসময়। এতে তার প্রতি অনেক মানুষের সফট কর্নার তৈরি হয়েছে, তার জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে, পর্দায় তিনি কমেডিয়ান হলেও, বাস্তবে যে তিনি সত্যিকারের নায়ক- এই ধারনা বদ্ধমূল হয়েছে অনেকের মনে।
আর তাতেই তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে দিয়েছেন। যে বিষয়ের বিন্দুবিসর্গ তার জানা নেই, সেই বিষয় নিয়েও বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার আসর খুলে বসেছেন। তিনি ধর্ষণের পেছনে তথাকথিত ওয়েস্টার্ন ড্রেসকে দায়ী করলেন অবলীলায়, অথচ অনন্তের সূত্র মেনে নিলে তার স্ত্রী বর্ষার পোশাক নিয়েও আপত্তি তুলতে পারে যে কেউ। আইটেম গানের নামে 'নোংরামির' পসরা তো অনন্তের সিনেমাতেও বসে, সেখানে নায়িকা বা আইটেম গার্ল নিশ্চয়ই বোরকা পরে নাচানাচি করেন না। আপাদমস্তক হিপোক্রেটের মতো তিনি যে জ্ঞানগর্ভ বাণীগুলো ছেড়ে গেলেন ছয় মিনিটের ভিডিওতে, সেটার একমাত্র কারন হচ্ছে অনন্ত জলিল জানেন, তার মতামতে বিশ্বাসী লোক প্রচুর আছে, তারাই বরং সংখ্যাগরিষ্ট, এই ভিডিওর পরে অনন্তকে তারা পীরের আসনে বসাবে।
ইউএনডিপির একটা গবেষণায় উঠে এসেছিল, ভারতীয় উপমহাদেশের শতকরা নব্বইজন মানুষই নারীবিদ্বেষী। এরা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে না, নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করে, একজন নারী যে কর্মক্ষেত্রে একজন পুরুষের সমান বা তারচেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষম হতে পারে, নারীর নেতৃত্ব যে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও বেশি ভালো ফলাফল এনে দিতে পারে, সেটা তারা মানতেই চায় না। এই দলটাই দেখবেন ধর্ষনের পেছনে নারীর পোশাককে দায়ী করে অপরাধী পুরুষটিকে ক্লিনচিট দিতে চায়, অনন্ত জলিলও তো এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বাইরের কেউ নন। ধর্ষণ নিয়ে তার এই ভিডিওবার্তা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই বানানো।
সুশিক্ষিত আর স্বশিক্ষিত হবার মধ্যে যে বিশাল একটা পার্থক্য আছে, সেটা অনন্ত জলিলকে দেখলেই বোঝা যায়। দুনিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হচ্ছে হার্ভার্ড, সেখান থেকে পড়ে এসেও অনেককে নারীদের নিয়ে কটু মন্তব্য করতে দেখেছি, নারী অধিকার বা নারীবাদ তাদের কারো কারো কাছে হাসিঠাট্টার বিষয়। অনন্ত জলিলও যতোই ম্যানচেস্টার (তার ভাষায় ম্যানসিস্টার) থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসুন না কেন, যতোই তিনি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ব্যবসায়ী হোন না কেন, মনের ভেতর তিনি নারীদের নিয়ে আদিম যুগের ধারনাই পোষণ করেন। সুশিক্ষা তাকে স্বশিক্ষিত করে তুলতে পারেনি, পারবে বলে মনেও হয় না।
ইস্যুর ভীড়ে জলিল সাহেবের এই বক্তব্য দুদিনেই হাওয়া হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই তাকে ডিফেন্ড করার জন্য তার সমগোত্রীয় চিন্তাধারার লোকজন নেমে পড়েছে মাঠে।তিনিও আরেকটা ভিডিওতে বলেছেন, কাউকে আঘাত দেয়ার জন্য নাকি তিনি কিছু বলেননি, যা বলেছেন 'সত্যি' বলেছেন! আমরাও গোল্ডফিশ মেমোরি নিয়ে দু'দিন পরে ভুলে যাব এই ইস্যুতে কি জঘন্য আর নোংরা একটা অবস্থান নিয়েছিলেন অনন্ত জলিল। কিছুদিন পরে তিনি কোথাও দান-খয়রাত করে ছবি আপলোড দিলে তাকে 'সুপারহিরো' খেতাবে ভূষিত করব (নিজেকেও বলছি এই কথা)। দোষ আমাদেরই, যে লোকটার টিকটক সেলিব্রেটি হবার কথা ছিল, তাকে আমরা ফিল্মস্টার বানিয়ে দিয়েছি মজা করতে করতেই। সেই মজার খেসারত তো আমাদেরকেই দিতে হবে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন