স্বামীকে নিয়ে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল থাকেন বার্লিনের পুরোনো এক ফ্ল্যাটে, নিরাপত্তা বলতে কেবল দুজন পুলিশ সদস্য! নিজের বাজার করতে নিজেই চলে যান সুপারমার্কেটে। কাজের ব্যস্ততা কম থাকলে বের হয়ে পড়েন ভ্রমণে। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী, অথচ তাঁর মধ্যে নেই কোনো অহঙ্কারের বালাই!

ধর্মযাজকের মেয়ে তিনি। পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করে কাজ করছিলেন একটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে। সেখান থেকে অনেক পালাবদল, অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে তিনি হয়েছিলেন জার্মানির প্রথম মহিলা চ্যান্সেলর। যিনি টানা চার মেয়াদ ধরেই আছেন জার্মানির চ্যান্সেলরের দায়িত্বে। শাসনামলে এসেছে একের পর এক চ্যালেঞ্জ। সব চ্যালেঞ্জকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। নিয়েছেন সাহসী সব সিদ্ধান্ত। কিছু সিদ্ধান্তে সমালোচনার মুখে পড়েছেন মানুষের। আবার কিছু সিদ্ধান্তে মানুষের হৃদয়ের খুব কাছেও চলে গিয়েছেন তিনি। তিনি অ্যাঙ্গেলা ডোরোটেয়া মার্কেল। কারো কাছে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মহিলা, কারো কাছে তিনি ইউরোপের সম্রাজ্ঞী, কারো কাছে জার্মানির রানী। কারো কাছে আবার খুব আদরের 'অ্যাঞ্জি।'

এই মানুষটিকে নিয়ে চাইলে অনেক কিছুই লেখা সম্ভব। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধস্রোতে দাঁড়িয়ে যেভাবে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন জার্মানিকে, প্রতিপক্ষকে যেভাবে চুপ করাচ্ছেন, চাইলে তা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে আজকের লেখায় থাকবে এক অন্যরকম অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। যিনি সাদাসিধে, যিনি মানুষের খুব কাছের, যিনি মনে করেন- চাকচিক্য না, সহজসরল থাকাটাই জীবনের সার্থকতা৷

যতই সাদাসিধে জীবনযাপন করুন, শাসক হিসেবে তিনি বরাবরই দৃঢ়! 

যেকোনো দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাড়ির সামনে হাই সিকিউরিটি প্রোটোকল দেখতে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক এক ব্যাপার। কিন্তু অ্যাঙ্গেলা মার্কেল যেখানে থাকেন, অর্থাৎ বার্লিনের সেই পুরোনো ধাঁচের ফ্ল্যাটের সামনে গেলে আপনি চমকে যেতে বাধ্য। দুইজন পুলিশ ছাড়া সেখানে আর কোনো সিকিউরিটির বালাই নেই৷ তিনি ও তার স্বামী বাড়িটিতে থাকেন, আর নিরাপত্তার জন্যে মাত্র দুইজন পুলিশ; এভাবেই চলছে। ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসেন অ্যাঙ্গেলা। কাজকর্ম থেকে একটু অবসর পেলেই চলে যান গ্রামের বাড়িতে৷ সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে আসেন বার্লিনে৷ সুইজারল্যান্ডে একবার বেড়াতে গিয়ে তো মারাই যাচ্ছিলেন প্রায়।আল্পস পর্বতের ঢালে বরফের ওপর স্কি খেলার সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। শয্যাশায়ীও ছিলেন অনেক দিন।

খেতে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। যখনই ঘরে রান্নাবান্না করতে পারেন না, স্বামীকে নিয়ে চলে যান রেস্টুরেন্টে। সেখানে গিয়ে ফেভারিট ফ্রেঞ্চ চিজ, গ্রিক মিটবল অর্ডার করেন তিনি। আবার যখন রান্না করার সময় পান, নিজেই সুপারমার্কেট থেকে বাজার করে আনেন। সাথে একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। বাজার থেকে নিজের পছন্দমতো জিনিসপত্র কিনতে ভীষণ ভালো লাগে তার । মাঝেমধ্যে কাজের ব্যস্ততায় নিজে যেতে না পারলে স্বামীকে পাঠিয়ে দেন বাজার করতে। তবে কখনোই বাইরের অন্য কোনো মানুষকে দিয়ে বাজার করান না। নিজেদের বাজার নিজেরাই করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

অ্যাঙ্গেলো মার্কেল'কে অনেক নাগরিক দেখেছেও সুপার মার্কেটে। তিনি সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করছেন... এরকম অনেক ছবিও ভাইরাল হয়েছে। এটা যে পলিটিক্যাল স্টান্টবাজির জন্যে তিনি করেন, বিষয়টি এমন না৷ তিনি নিজের কেনাকাটা, বাজার নিজে করেই স্বস্তি পান, তাই এভাবেই সাধারণের কাতারে নেমে আসতে দুইবার ভাবেন না আর।

নিজের কাজকর্ম নিজে করতেই পছন্দ করেন তিনি! 

অ্যাঙ্গেলো মার্কেল এখনো তাঁর পছন্দের একটি সেলুনে গিয়ে নিয়মিত চুল কাটেন। জার্মান চ্যান্সেলর হওয়ার আগে যেরকম তিনি যেতেন সেলুনে। এখনও যান। আগে ৬৮ ইউরো দিয়ে চুল কাটতেন। এখনও সেভাবেই কাটেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে।  বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলের মালিক তার এক টকশো'তে জানিয়েছিলেন, টানা ত্রিশ বছর ধরে নাকি সেলুনে যান না তিনি। নাপিত সবসময় তার বাসায় এসে চুল কেটে দিয়ে যায়। অনেকেই হয়তো চিনতে পেরেছেন তাকে। না চিনলে আরেকটা হিন্ট দেই। তিনি গানও গান তার চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে। অ্যাঙ্গেলো মার্কেলের লেখায় এই ভদ্রলোকের প্রসঙ্গ কেন টেনে আনলাম, তা সচেতন পাঠক হয়তো বুঝতে পেরেছেন। সেদিকে আলোকপাত আর না করি বরং!

করোনাভাইরাসের সময়ে অ্যাঙ্গেলা মার্কেলোর প্রশাসন শক্তভাবে কাজ করেছে সংক্রমণ কমানোর জন্যে। মহামারীর আগে সারাবিশ্বে যখন শরনার্থী-সমস্যা চলছিলো, তখন শরনার্থীদের জন্যে সীমান্ত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও দিয়েছিলেন তিনি। আবার তিনিই এ বছরে আমেরিকার জি-৭ সম্মেলনের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন, বলেছেন- মহামারীর মধ্যে সশরীরে কোনো সম্মেলনে তিনি যাবেন না। কোমলে-কঠোরে মিশ্রিত এক চরিত্র তিনি। নিজের বাজার নিজে করেন, নিজের মত করে বেড়াতে পছন্দ করেন, নিজের সাদামাটা বাড়িতে নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে না থেকে সহজ-সরল এক জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। অথচ তিনিই আবার বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মহিলা। ভাবা যায়!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা