তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের রাস্তাটা উদ্ধার হয়েছিল শুধু আনিসুল হক ছিলেন বলেই, অন্য কেউ সেটা পারতো না কখনও।

এই শহরে একজন ভালো মানুষ ছিলেন। শহরটাকে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন আর মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। এই শহরটা সবুজে ঢাকা পড়বে, বাচ্চাদের খেলার জন্যে মাঠ থাকবে এখানে, ফুটপাত থাকবে ফাঁকা, সাইকেলর জন্যে থাকবে আলাদা লেন, রাস্তার পাশে পড়ে থাকবে না আবর্জনা, বাস টার্মিনাল হবে শহরের বাইরে- এগুলো ছিল তার স্বপ্ন। 

আনিসুল হক নামের সেই মানুষটা শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত থাকেননি, কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিলেন সেই স্বপ্নগুলোকে পূরণ করার তাগিদে। আনিসুল হক নেই এখন, তার রেখে যাওয়া কাজগুলো আছে, আছে তার স্মৃতি। সিটি কর্পোরেশনের আরেকটা নির্বাচন হয়ে গেল, সেটা নিয়ে ঢাকার মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা না থাকলেও, মৃত্যুর এতদিন পরে এসেও ঢাকার বুকে আনিসুল হক ভীষণ প্রাসঙ্গিক। যে মানুষটা ঢাকাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন, তাকে ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?

ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে পুরনো একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম তার। মেয়র হবার দুই বছর পুর্তির সময়টায় নিজের কাজের ফিরিস্তি দিতে হাজির হয়েছিলেন তিনি, খালেদ মুহিউদ্দিন ছিলেন সঞ্চালক। উপস্থিত ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদও। ১৪/১৫ মিনিটের ভিডিও ক্লিপ দেখেই মনে হতে লাগলো, আমরা বোধহয় জানিও না কি অমূল্য রত্নটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি! 

আনিসুল হক

আনিসুল হক এমন একজন মানুষ ছিলেন, প্রভাবশালীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যিনি অবৈধ স্থাপনার ওপর বুলডোজার চালিয়েছেন বারবার। অথচ সেই একই মানুষটাই ফুটপাথ থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ করার সময় ভেবেছেন, এদের উঠিয়ে দিলে হয়তো আজ রাতে বাড়িতে চুলা জ্বলবে না, হকারের সন্তানেরা অভুক্ত থাকবে। যে মানুষটা নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তাটা উদ্ধার করেছিলেন, কাউকে ভয় পাননি, মাথা নত করার কথা ভাবেননি একবারও, সেই একই মানুষটা আবার অবৈধ হকার উচ্ছেদ করেও তাদের ব্যথায় সমব্যাথী হয়েছেন, তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনাটা আচ্ছন্ন করেছে তার মনকে! কোমলতা আর কঠোরতার এমন অদ্ভুত মিশ্রণ খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। আনিসুল হক সেই বিরল প্রজাতির একজন ছিলেন।

আনিসুল হক রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন টিভি ব্যক্তিত্ব, তারপর উদ্যোক্তা হলেন, নিজেকে পরিণত করলেন দেশের সবচেয়ে সফল ব্যাবসায়ীদের একজন হিসেবে। নেতৃত্বগুণ জিনিসটা তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির অংশ, প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ভরসা করেছিলেন সেকারণেই। তাকে দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি সামলানোর দায়িত্ব। তখন কত সমালোচনা, কত প্রশ্ন, লোকজনের হাজারো শঙ্কা। সেসবকে উড়িয়ে দিয়ে আড়াই বছরে আনিসুল হক যে পরিমাণ কাজ করেছিলেন, সেটা স্বাধীনতার পরে পঁয়তাল্লিশ বছরেও ঢাকায় কেউ করতে পারেনি! 

তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের রাস্তাটা উদ্ধার হয়েছিল শুধু আনিসুল হক ছিলেন বলেই, অন্য কেউ সেটা পারতো না কখনও। ঢাকা উত্তরের ফুটপাথগুলো এখন হাঁটার উপযোগী, তৈরী হয়েছে প্রতিবন্ধী বান্ধব ফুটপাথও। রাস্তাঘাটে যাতে ময়লা আবর্জনা না জমে, এজন্যে ৫২টি স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন। শৃঙ্খলা এসেছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। ১১টি আধুনিক গণশৌচাগার স্থাপিত হয়েছে, সবগুলোই পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত। 

ঢাকা শহর একটা সময় বিলবোর্ডে ছেয়ে গিয়েছিল, এসব বিলবোর্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রভাবশালীদের হাতে, এগুলোকে কোনভাবেই সরানো যাচ্ছিলো না। আনিসুক হক এসে বিশ হাজার বিলবোর্ড উচ্ছেদ করেছিলেন, কারো কথায় কান দেননি, অনুনয় শোনেননি, হুমকিতে ভয় পাননি। নিজে দাঁড়িয়ে একেকটা জায়গায় বিলবোর্ড উচ্ছেদ করিয়েছেন, কারো সাহস হয়নি তার সামনে এসে দাঁড়ানোর। বিশা প্রভাবশালীরা চুনোপুঁটির মতো মিইয়ে গিয়েছে তার সামনে।

ঢাকার মানুষ আনিসুল হককে মনে রাখবে

যানজট কমাতে ঢাকা জুড়ে বানানো হচ্ছে ইউলুপ বা ইউটার্ন, কাজটা শুরু করে গিয়েছিলেন আনিসুল হকই। গণপরিবহনগুলোকে একটা নীতির ভেতরে নিয়ে আসার জন্যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো করে ছুটেছেন, অকালে হারিয়ে না গেলে হয়তো সেটাও করে দেখাতেন। পরিবহন শ্রমিকদের দৌরাত্ন্যের অবসান হতো তাতে। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে দখলে থাকা জমি উদ্ধার করেছেন তিনি, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মোনায়েম খানের বাড়ি। 

গুলশান অ্যাভিনিউয়ের বেশিরভাগ অংশ দখল করে রেখেছিলেন প্রভাবশালীরা, আনিসুল হক মিষ্টি ভাষায় তাদের অনুরোধ করেছেন, কাজ না হলে বুলডোজার এনে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দখল করা জায়গা সিটি কর্পোরেশনের আওতায় নিয়েছেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে তিনি প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে দিচ্ছিলেন। উত্তরে তিনি যতোদিন ছিলেন, চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও দক্ষিণের মেয়রকে কাজ করতে হয়েছে। আনিসুল হক থাকার সময় দক্ষিণের মেয়রের কাজ, আর আনিসুক হকের মৃত্যুর পরে দক্ষিণের কাজকে মেলালেই জিনিসটা পরিস্কার হয়ে যাবে।

আনিসুল হক এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি নিজের ছাপটা রেখে গেছেন, কাজের মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন আমাদের হৃদয়ে। চিরকাল তো কেউই বেঁচে থাকে না, টিকে থাকে কাজ। আনিসুল হক সেটা পেরেছিলেন। তাই মৃত্যুর পরেও ঢাকার উন্নয়ন শব্দটা শুনলে সবার আগে আনিসুল হকের চেহারাটাই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, এই শহরটাকে যিনি বদলে দিতে চেয়েছিলেন! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা