করোনার চিকিৎসা ও আনোয়ার খান মেডিকেলের পুকুরচুরি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এদেশের মানুষ শুধু শুধু ডাক্তারদের কসাই বলে। আসল কসাই তো হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো, যারা ভুতুড়ে বিল বানিয়ে রোগীদের জিম্মি করে ব্যবসা করে। ডাক্তারদের পকেটে তো যায় শুধু ভিজিটের টাকাটাই...
‘করোনার জন্যে ডেডিকেটেড’ হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসার খরচ সরকার দিচ্ছে, এটা জেনেই ঢাকার আনোয়ার খান মডার্নে ভর্তি হয়েছিলেন সাইফুর রহমান নামের এক রোগী। কিন্তু দুইদিন আগে রিলিজের সময় তাকে যে বিলটা ধরিয়ে দেয়া হলো, সেটা দেখে চক্ষু চড়কগাছে উঠেছে সাইফুর এবং তার পরিবারের। এক লাখ সত্তর হাজার টাকা এসেছে বিল, সেই টাকা দিতে বিলম্ব হওয়ায় রোগীকে ছাড়ছিল না হাসপাতালটি। মিডিয়ায় এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও মন গলেনি কর্তৃপক্ষের। শেষমেশ দেড় লাখ টাকা দিয়ে হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন সাইফুর, সাক্ষী হয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার জঘন্য এক বাস্তবতার।
রাজধানীতে যে ১৩টি সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড-১৯ চিকিৎসা দিচ্ছে, তার মধ্যে ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ন একটি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়েছিল। এজন্য আরও কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে মে মাস থেকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল ‘কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। সেখানে করোনায় আক্রান্ত ২০০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সুবিধা রয়েছে। এই চিকিৎসার পুরো খরচটাই বহন করবে সরকার- এটা জানানো হয়েছে শুরুতেই।
তবে সরকারের সেই নির্দেশের থোড়াই কেয়ার করছে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল। সাইফুরের ঘটনাটাই তাদের অব্যবস্থাপনা এবং লোভী আচরণের একমাত্র নজির নয়। আরও কয়েকজন রোগী এবং রোগীর স্বজনের কাছ থেকে এরকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাখ লাখ টাকার ভুতুড়ে বিল ইস্যু করা হয়েছে, সেই বিল আবার ব্যাংজ একাউন্ট বা কার্ডের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে না, পুরো টাকাটাই পরিশোধ করতে হবে ক্যাশ টাকায়! কাজেই রোগীর স্বজনদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে সেবার নামে নজিরবিহীন এক ব্যবসায় নেমে পড়েছে হাসপাতালটি।
মে মাসের ২৩ তারিখে করোনা পজিটিভ নিয়ে আনোয়ার খান মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন সাইফুর। তিনি বলেছেন, ভর্তি হওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত তার রক্তের দুটি পরীক্ষা এবং তিনটি এক্সরে হয়েছে। আর হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করেছে শুধু নাপা ট্যাবলেট। য়ার কোনো অক্সিজেনেরও প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এক লাখ সত্তর হাজার টাকা বিল করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাইফুরের বিলের কাগজে দেখা গেছে, ২ জুন পর্যন্ত চিকিৎসকের বিল বাবদ ১৮ হাজার ৭০০ টাকা, হাসপাতালের বিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৭০ টাকা, পরীক্ষার বিল ১৯ হাজার ৪৭৫ টাকা, ওষুধের বিল ৫ হাজার টাকা এবং ১২ হাজার ৯০৩ টাকা সার্ভিস চার্জ ধরে ওই বিল সাইফুরকে ধরিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেছেন, ডেডিকেটেড করোনা হাসপালগুলোতে এভাবে বিল নেয়ার কোন সুযোগই নেই। এই টাকার পুরোটাই দেবে সরকার। তার কথা হচ্ছে- “এখানে রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো কমপ্লিটলি ফ্রি। আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালেও চিকিৎসা ফ্রি। যখনই হাসপাতালটা সরকার নিল, তখন তো আনোয়ার খানকে টাকাটা সরকার দেবে। রোগীর ট্রিটমেন্ট হবে ফ্রি।”
অথচ এসব ভুতুড়ে বিলের ব্যাপারগুলো গণমাধ্যমে আসার পরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেলের পক্ষ থেজে বলা হয়েছে, মে মাসেই নাকি সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। কিন্ত সেটা তারা রোগীদের জানানোর দরকার মনে।করেনি। আনোয়ার খান মেডিকেল যে সরকারী চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে, সেই বিষয়টা নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচিবও। সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, "চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও ৩১ মে পর্যন্ত কোনো করোনা রোগীর কাছ থেকে বিল নেওয়া চলবে না। বিল ধরলে ১ জুন থেকে বিল নেবে। এই কয়দিন তারা সরকারি হিসাবে চলেছে।”

তাহলে সাইফুরকে যে এক লাখ সত্তর হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হলো, সেটা কয়দিনের? এই পুকুরচুরি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে তারা বলেছে এই বিল পূনর্বিবেচনা করা হবে, সেই মতে রোগীর ভাইকে ডেকে নিয়ে ডাক্তারের ভিজিট, দুইদিনের কেবিন ভাড়া, ওষুধের বিল, অক্সিজেনের খরচ- এসব বাদ দিয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ফেরতও দিয়েছে হাসপাতালটি। কিন্ত যদি সাইফুরের ঘটনাটা মিডিয়ায় না আসতো? যদি ঝামেলা করতে না চেয়ে সাইফুর বিলটা মিটিয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে যেতেন? যদি গণমাধ্যমগুলো অনুসন্ধান করে আনোয়ার খান মেডিকেলের এই বর্বর আচরণের খোঁজ বের না করতেন- সেবার নামে লুটপাটের এই মহোৎসব তো চলতেই থাকতো। করোনার এই ক্রাইসিস মোমেন্টে সেবার চেয়ে ব্যবসাটা যাদের কাছে বড়, ডেডিকেটেড হাসপাতাল থেকে যারা সরে যেতে চাইছে স্বেচ্ছায়- তাদের কাছে আর কিইবা আশা করা যায়?
এদেশের মানুষ পান থেকে চুন খসলে ডাক্তারদের গালি দেয়, কসাই বলে ডাকে। ডাক্তারদের দোষ তারা কেন ৫০০/১০০০ টাকা ভিজিট নেন। অথচ স্বাস্থ্য খাতটাকে সেবার পরিবর্তে ব্যবসা খাতে পরিণত করার পেছনে মূল কালপ্রিট হচ্ছে হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলো। লাখ লাখ টাকার ভুতুড়ে বিল বানাতে যারা কার্পণ্য করে না, সরকারের সঙ্গে চুক্তি থাকার পরেও যারা জনগনের পকেট থেকে অন্যায্যভাবে টাকা কেটে নেয়। কসাই বলে কাউকে গালি দিতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে গালি দিন, ডাক্তারদের নয়...