অপূর্ব-নাজিয়া দম্পতির ডিভোর্স নিয়ে যারা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, সেগুলো এবং স্ট্যাটাসের মন্তব্যগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বিস্মিত হইনি। যা পড়বো ভেবে পড়া শুরু করেছি, তাই দেখতে পাচ্ছি। "এরা এমনই, এদের নীতি/ঈমান নাই, এরা চরিত্রহীন, এদের জন্য এগুলো কোন ব্যাপারই না" ইত্যাদি ইত্যাদি। ডিটেইলে গেলাম না, বুঝে নেন।
লোপা হোসেইন: তো এই "এরা, এদের" বলতে বোঝানো হচ্ছে মিডিয়ায় কাজ করা মানুষদের। সংগীত শিল্পী, অভিনয় শিল্পী, নৃত্য শিল্পী, বাচিক শিল্পী, উপস্থাপক, লেখক, মডেলদের। এই মানুষগুলো মিডিয়ায় কাজ না করা মানুষদের চোখে "এলিয়েন", মানুষ না। তাও আবার খুব দুষ্টু টাইপের এলিয়েন। যাদের কাজই হল নানারকম দুষ্টুমি করা,অনেকগুলো প্রেম করা,অনেকগুলো বিয়ে করা আর অযথা ডিভোর্স দেয়া। ভালো কোন কাজের মধ্যে এরা নাই। খুব ভালো কথা। তো আমাদের নিয়ে আপনাদের এত অতি আগ্রহের কারণ কি? খারাপদের নিয়ে যাদের আগ্রহ, তারা তো ভালো হবার কথা না, তাই না?
এবার একটু সত্যের মুখোমুখি হন। আপনারা যারা মিডিয়ার ঝলমলে দুনিয়ার বাইরে বাস করেন, তাদের সবসময় এই দুনিয়ার প্রতি এবং এই দুনিয়ার মানুষদের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। এর কৃতিত্ব এই ঝলমলে দুনিয়ার মানুষদের। কারণ এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই বিশেষ কিছু গুণ নিয়ে জন্মেছেন। আল্লাহ পাক কারও কন্ঠে সুর দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে গানের কথা আর সুর সৃষ্টির মাধ্যমে দারুণ সব গান তৈরির ক্ষমতা দিয়েছেন,কাউকে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে হাসাবার এবং কাঁদাবার ক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে নৃত্যের তালে তালে মাতানোর ক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দিয়েছেন, কাউকে হৃদয়গ্রাহী সব নাটক/সিনেমা নির্মাণের ক্ষমতা দিয়েছেন, কাউকে দিয়েছেন লেখনীর জাদুতে অন্য এক জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা- এই মানুষগুলো সবাই সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট। এই আশীর্বাদকে তারা তাদের শিক্ষা, পরিশ্রম আর পরিচর্যার মাধ্যমে আরও শাণিত করেন। অনেক মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন৷ এটা এই জগতের মানুষদের যোগ্যতা, সাফল্য। আর যাদের এই আশীর্বাদ আল্লাহ তায়ালা দেননি, যারা অন্য পেশায় আছেন, তাদেরকে চিন্তা, মনোভাব এবং এর বহিঃপ্রকাশ অনুযায়ী ৩টি দলে ভাগ করা যায়-
১. থাক। অভিনয়/গান/নাচ করতে পারি না তো কি হয়েছে? আমি আমার কাজে দক্ষ হব, বড় হব, সফল হব।
২. ইশ,আমিও যদি এরকম গাইতে/নাচতে/অভিনয় করতে পারতাম! আমিও যদি ওই নায়ক/নায়িকার মত সুন্দর হইতাম! আমি যদি কোন ক্রিকেটাররে বিয়ে করতে পারতাম! কেন যে পারলাম না!
৩. ইশ, হইসে তো কি হইসে? কোন বালটা ছিঁড়সে? এগুলার কোন চরিত্র নাই, নামাজ-রোজা নাই। মিডিয়ার সবাই খারাপ। মদখোর, নাস্তিক, লুইচ্চা, বেশ্যা সবগুলো।
প্রথম দুটো দলের মানুষ হলেন স্বাভাবিক মানুষ। এরাই মূলত আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়, ভক্ত হয়, গঠনমূলক সমালোচনা করে। আবার আমরা অসুস্থ হলে বা কষ্টে থাকলে সহানুভূতিশীল আচরণ করে। আমরাও মূলত কাজ করি এই দুটো দলের জন্যই। আপনারা আছেন বলেই, ভালোবাসেন বলেই আমরা বেঁচে আছি, কাজ করার শক্তি এবং অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। আপনাদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ এবং সালাম।
তবে তৃতীয় দলের সদস্য যারা আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- আমাদের কোন কাজ আপনাদের জন্য নয়। কারণ আপনারা মানসিকভাবে অসুস্থ। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য নয়। খুব বাজেভাবে হতাশাগ্রস্ত আপনারা, যা আপনাদের অনেকেই জানেনও না। আপনারা আনন্দে, দুঃখে আমাদের গাওয়া গানের সাথে নাচেন, কাঁদেন, আমাদের অভিনীত নাটক/সিনেমা উপভোগ করেন, মাঝে মাঝে নাটক সিনেমার কোন চরিত্রের সাথে নিজের মিল খোঁজার চেষ্টা করেন বা খুঁজে পান, আমাদের লেখা উপন্যাস/গল্প/কবিতার বই আগ্রহ করে কেনেন অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফসহ। আমাদের নিয়ে গণমাধ্যমে আসা লেখাগুলো পড়েন, রিপোর্টগুলো দেখেন। কিন্তু সুযোগ পেলেই দু'চারটে গালি দিয়ে নিজের হতাশা ঝাড়েন আর অসুস্থতার প্রকাশ ঘটান। এমনভাবেই প্রকাশ ঘটান যে আপনাদের শিক্ষা, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, রুচি, ধর্মীয় কুশিক্ষা সব কিছু আমাদের জানা হয়ে যায়। সাব কনশাস মাইন্ডে লুকিয়ে থাকা হতাশা আর ধর্মান্ধতা আপনাদের কথায় এমনভাবে প্রকাশ পায় যা আপনাদের ভার্চুয়ালি নগ্ন করে দেয়। অথচ আপনারা তা টেরও পান না। আপনাদের মত মানুষদের জন্যই সেই শেয়ালের গল্প - "আঙুর ফল টক"।
মিডিয়ার ঝলমলে জগতে বিচরণ করলে আপনারা জানতেন যে এই জগতে নিজেদের ভালো রাখা কতটা কঠিন৷ অথচ এই কঠিন কাজটাই মিডিয়ার মানুষদের বড় একটা অংশ করে যাচ্ছেন। কারণ তারা যেকোনো কথা বলার আগে, যেকোনো কাজ করার আগে তার ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা ভাবে। ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ কোন সাধারণ মানুষ বিয়ে করলে বা ডিভোর্স দিলে তা " নিউজ" হয় না, মিডিয়ার মানুষদের হয়। রাগ হলে, ঘৃণা হলে আমরা মন খুলে গালিও দিতে পারি না। আর কেউ দিলে সেটা নিয়ে ছি ছি হয়। অথচ অন্যরা কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় জঘন্য সব ভাষার প্রয়োগে গণতান্ত্রিক অধিকার ঠিকই অপপ্রয়োগ করছেন। তবে যেহেতু আমরা মানুষ, এলিয়েন নই, তাই আমাদেরও ভুল হয়, অন্যায় হয়। ঠিক যেমন করে মিডিয়ার বাইরের মানুষদের হয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর যত ডিভোর্স হয়, তার কত শতাংশ মিডিয়া কর্মী? আমার তো মনে হয় ১০% এর বেশী হবে না। বড়জোর ১৫%৷ তো বাকি ৯০- ৮৫% মানুষদের ডিভোর্স কেন হয়? মিডিয়ায় কাজ করে না, কিন্তু ৩/৪ টা বিয়ে আর ডিভোর্স আছে, পরকীয়া করছে, অনেকগুলো প্রেম করছে আর ছাড়ছে, যৌন হয়রানি করছে, এরকম অনেককেই আমি জানি। তাদের সম্পর্কে কি বলবেন তাহলে? একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন- মিডিয়ার মানুষ হোক কিংবা মিডিয়ার বাইরের, নায়ক হোক বা সাধারণ চাকুরিজীবী, নায়িকা হোক বা গৃহিণী, মানুষ বিয়ে করে বিয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সুখে থাকার জন্য। ভালোবাসা পাবার জন্য। পরিবার নিয়ে থাকার জন্য। যখন একেবারেই একত্রে থাকা সম্ভব হয় না, তখনই মানুষ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়। সেলিব্রিটি হোক বা সাধারণ মানুষ, ডিভোর্স সবার জন্যই কষ্টদায়ক, বিব্রতকর।
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। না বুঝলে বা ভুল বুঝলে আবার পড়ার অনুরোধ। আর তারপরও না বুঝলে বা ভুল বুঝলে বুঝতে হবে যে আপনার এখনো অনেক কিছু বোঝার বাকি আছে।
বিঃদ্রঃ এই লেখা মোটেও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে নয়। সাংবাদিকরাও আমাদের মত মিডিয়াকর্মী। এই লেখা তাদের জন্য, যাদের ভালোবাসা,শ্রদ্ধা আর প্রশংসা পাওয়ার জন্য আমরা মিডিয়াকর্মীরা কাজ করি।