আরাজ তখন চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘স্টপ ভিডিও, স্টপ ভিডিও। তুমি জানো আমি কে? হু ইজ মাই ড্যাড? আমি মাহী বি চৌধুরীর ছেলে।’

বাঙালী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ভালোবাসে। সেকারণে দল ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের পাঁতি নেতারাও দেখা যায় সঙ্গে বিশ-পঁচিশজনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, একটা ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করেন, হাবেভাবে বুঝিয়ে দিতে চান, তারা কত বড় হনু, কী বিশাল তাদের ক্ষমতা! চুনোপুঁটিও তখন তিমি মাছের আকার ধারণ করে, অন্তত সেরকমটা দেখানোর একটা চেষ্টা থাকে সবসময়। 

আরাজ বি চৌধুরীও তার ব্যতিক্রম নন। তার দাদা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বাবা বর্তমান সাংসদ, সেই হিসেবে এই দেশে তিনি যথেষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সেই ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাতেই পারেন, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে উল্টো পুলিশের ওপর হামলে পড়তেই পারেন, পুলিশ সদস্যের জামা-কাপড় ছিঁড়েও ফেলতে পারেন। তার জন্যে এগুলো সবই জায়েজ। ক্ষমতাবানের ছেলে বলে কথা! ছোটবেলায় একটা আঞ্চলিক প্রবাদ পড়েছিলাম, আড়াই হাত কাঁকুড়ের নাকি তেরো হাত বিচি! আরাজ বি চৌধুরীর অবস্থা দেখে সেই প্রবাদটার কথা মনে পড়ে গেল। 

সুবক্তা হিসেবে খ্যাতি আছে মাহী বি চৌধুরীর। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর একমাত্র সন্তান তিনি, নানা কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিয়মিতভাবে আলোচিত ব্যক্তিত্বদের একজন মাহী বি চৌধুরী। মাঝখানে তার প্ল্যান-বি নামের একটা ভিডিওবার্তা বেশ সাড়া ফেলেছিল নেটিজেনদের মাঝে। একসময়ে উপস্থাপক হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, কথার মাধুর্য্যে মুগ্ধ করতেন দর্শককে। তবে তার গুণধর পুত্র আরাজ বি চৌধুরী এসব জনপ্রিয় হবার পথে হাঁটতে চান না, তার ইচ্ছা সম্ভবত বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিরোনাম হওয়া। নইলে কী আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আবার পুলিশকে মারধর করেন তিনি! 

ঘটিনাটা বুধবার রাতের। বনানী কবরস্থান রোডে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন আরাজ। গাড়িটি একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। অটোরিকশাটি সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল আলমগীরের পায়ে আঘাত করে। এরপর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা মাহী বি চৌধুরীর ছেলেকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আরাজ বি চৌধুরী। তার সঙ্গে আরেকজন যুবকও ছিলেন। দুজন গাড়ি থেকে নেমে আলমগীরকে মারধর করেন, এমন অভিযোগই করেছেন ট্রাফিক পুলিশের এই সদস্য।

আরাজ বি চৌধুরী

সেখানে তখন লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কয়েকজন মোবাইলের ক্যামেরায় ভিডিও করছিল আরাজ এবং তার সঙ্গীর এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ। আরাজ তখন চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘স্টপ ভিডিও, স্টপ ভিডিও। তুমি জানো আমি কে? হু ইজ মাই ড্যাড? আমি মাহী বি চৌধুরীর ছেলে।’ পুলিশ সদস্যরা তখন দুজনকে কাছের পুলিশ বক্সে নিয়ে যায়, সেখানেও চিৎকার চেঁচামেচি অব্যহত থাকে তাদের। ভিডিও ধারণকারীদের প্রাণ নাশের হুমকি দিয়েছেন আরাজ, এমন অভিযোগও এসেছে।

ততক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে এসেছেন আরাজের বাবা মাহী বি চৌধুরী। তাকে সহ পুলিশ গেল বনানী থানায়, সেখানে মিনিট পাঁচেক অবস্থান করার পরে ছেড়ে দেয়া হয় আরাজকে। বনানী থানার ওসি বলেছেন, “থানায় পাঁচ মিনিট ছিলেন আরাজ। ট্রাফিক সার্জেন্টকে ‘সরি’ বলায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।” ছেলেকে নিতে থানায় মাহী বি চৌধুরী এসেছিলেন জানিয়ে ওসি বলেন, আরাজকে সার্জেন্ট মাফ করে দিয়েছেন। 

তবে মাহী বি চৌধুরী দাবি করেছেন, আরাজ সড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়নি। তিনি কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের কাছে বলেছেন, “রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার ছেলের কাছে বিদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। ওটা নিয়ে তর্ক হয়েছিল। আমি নিজে থানায় গিয়ে ছেলেকে বলেছি, বড়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ কেন? সেজন্য তাকে দিয়ে ‘সরি’ বলিয়েছি।”

সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্যে আমরা শাজাহান খানকে দায়ী করি, পরিবহন শ্রমিকদের দোষ দেই, আরাজ বি চৌধুরীর মতো শিক্ষিত লোকজন যখন বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে আবার ফালতু মামদোবাজী করে, তখন বলার ভাষা হারিয়ে যায় আমাদের। বড়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্যে মাহী বি চৌধুরী ছেলেকে দিয়ে স্যরি বলিয়েছেন, এটা খুবই ভালো। আশা করি ছেলেকে এই শিক্ষাও তিনি দেবেন যে, ভুল বা অন্যায় করার পরেও স্যরি বলতে হয়, মাফ চাইতে হয়, দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। সেটা না করে কেউ যদি বাপ-দাদার নাম নিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করে, অবৈধভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে, সেটাকে দুর্বৃত্তায়ন বলে। ভালো বংশ, উচ্চশিক্ষা, এসবও যদি ভালো ব্যবহারের কারণ হতে না পারে, তাহলে ব্যাপারটা খুবই হতাশজনক হয়ে দাঁড়ায়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা