একজন তুখোড় সাংবাদিক, হাজারো মানুষের আইডল কিভাবে একটা রাজনৈতিক দলের পেইড প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হতে পারেন, সেটার একটা দুর্দান্ত কেস স্টাডি হতে পারে অর্ণব গোস্বামীর ক্যারিয়ারটা। 'হলুদ সাংবাদিকতা' টার্মটাও যার জন্য কম পড়ে যাবে...

উপমহাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে সরকারের পদলেহন করার চর্চাটা অনেক পুরনো। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কা- সব জায়গাতেই এরকম উদাহরণ পাবেন। কিছু লোক সব দেশেই থাকে, যারা সাংবাদিকতার নামে নির্দিষ্ট কোন দলের পক্ষে কাজ করে, বয়ান দেয়, মূল খবরটাকে একটু উল্টেপাল্টে ভিন্নভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশন করে, যাতে সেই ঘটনার মানেটাই অনেক সময় বদলে যায়। অনেক মিডিয়া হাউজই যেহেতু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত লোকজন চালান, সেক্ষেত্রে বায়াসড হবার সম্ভাবনা কমবেশি সব জায়গাতেই থাকে।

কিন্ত ভারতের অর্ণব গোস্বামী যেটা করেছেন, সেটা বিরল এক দৃষ্টান্ত। ক্যারিয়ারের লম্বা একটা সময় ধরে সৎ সাংবাদিকতা করে, মানুষের বাহবা পেয়ে, সাংবাদিক সমাজের পোস্টারবয়ে পরিণত হবার পরে কেউ যদি নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সাংবাদিকতা পেশাটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে- সেটা দেখে যে কেউ অবাক হবেন। সাংবাদিক অর্ণব এবং প্রোপাগান্ডা স্পেশালিস্ট অর্ণব- গোস্বামীবাবুর ক্যারিয়ারের দুটো ভাগই যারা দেখেছেন, তারাই জানেন বিবর্তনের এই অদ্ভুত রহস্যটা। সাংবাদিকতার যে কোন ছাত্রছাত্রীর জন্য দারুণ একটা কেস স্টাডি হতে পারে অর্ণব গোস্বামীর এই পরিবর্তন।

অর্ণব গোস্বামীকে প্রথম দেখি ২০১৩-১৪ সালের দিকে, শাহরুখ খানের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে ছিলেন। তখন তিনি ভারতের টাইমস নাউ চ্যানেলে সাংবাদিকতা করেন, রাত নয়টার প্রাইম টাইমে তার শো যায়, রাজনীতিবিদদের জন্য যেটা আতঙ্কের নাম ছিল। কংগ্রেস তখন কেন্দ্রের সরকারে, অর্ণব একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত করতেন কংগ্রেসের নেতাদের। দুর্নীতি, কালোবাজারি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতেন নিজের টকশোতে। সেসব অবশ্য অনেক পরে দেখেছি।

অর্ণব গোস্বামী

শুধু যে কংগ্রেসকেই দুষতেন অর্ণব, ব্যাপারটা এমন নয়। হিন্দুত্ববাদকে সামনে রেখে রাজনীতি করা বিজেপিকেও ছাড় দিতেন না তিনি। যোগী আদিত্যনাথকে তিনি সরাসরিই বলতেন 'ভণ্ড যোগী, ধর্ম ব্যবসায়ী', কিংবা যে 'বাবা' রামদেবের কোলে আজকাল তিনি চড়ে বসেন (আক্ষরিক অর্থেই কোলে চড়েছেন, ইউটিউবে সার্চ দিলেই ভিডিও পাবেন), সেই রামদেবকে তার পতঞ্জলীর ব্যবসা, তার যোগ ইন্সটিটিউটের আয় কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির প্রসঙ্গে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতেন অর্ণব।

এর আগে যখন এনডিটিভিতে ছিলেন, তখনও এই কাজটা করেছেন অর্ণব, আরও দুর্ধর্ষভাবেই করেছেন বলা যায়। এনডিটিভিতে থাকা অবস্থাতেই নিজেকে অন্যরকম একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, নিজের একটা ব্র‍্যান্ডভ্যালু তৈরি করেছিলেন। মধ্যত্রিশেই অর্ণব গোস্বামী সাংবাদিকতার মাধ্যমে যে ক্রেজ তৈরি করেছিলেন। ভারতবর্ষে আর কেউ এতটা পারেননি বোধহয়। অর্ণব তখন সহকর্মীদের কাছে ঈর্ষার আরেক নাম, অজস্র তরুণ-তরুণীর কাছে আইডল। ২০১০-১৪ সালের মধ্যে অর্ণবের ক্রেজ বলিউডের কোন ফিল্মস্টারের চাইতে কম ছিল না বোধহয়।

আমাদের যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ- কবি লিখে গেছেন। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, নক্ষত্রদেরও নাকি মরে যেতে হয়। অর্ণবও মরে গেলেন, অন্তত তার ভেতরকার মিস্টার জেকিলটা মরে গেল, টিকে রইলো শুধু মিস্টার হাইডের বীভৎস রূপটা। ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় এলো, বদলে গেলো অর্ণবের সাংবাদিকতার প্যাটার্ন। আরও আগে থেকেই বদলে যাচ্ছিল হয়তো  মোটাদাগে চোখে পড়ল ২০১৪ থেকে, বা এর পরের সময়টায়। মিডিয়াকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, ভারতে সেই স্তম্ভ ধ্বংসের মিশনে নামলেন অর্ণব গোস্বামী। শুরু করলেন সাংবাদিকতার নামে সরকারের তৈলমর্দন, আর সরকার বিরোধীদের তুলোধোনা করা।

বাবা রামদেবের সঙ্গে এখন তার ভীষণ খাতির

নিজের টকশোতে ডেকে এনে দেশের যাবতীয় সমস্যার জবাবদিহিতা তিনি চাইতে থাকলেন বিরোধীদের কাছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি, সিদ্ধান্ত সব মোদির নেয়া, অথচ অর্ণব দোষারোপ করেন মনমোহন সিংকে। পাকিস্তানী জঙ্গীরা উরিতে আক্রমণ করে, কাশ্মীরে হামলা চালায়, আর অর্ণব মোদি সরকারকে কিছু না বলে দোষ চাপান রাহুল গান্ধী আর সোনিয়া গান্ধীর ওপরে। চীনের সৈন্যরা ভারতের ভূমি দখল করে, নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে চীনের নাম নেয়ারও সাহস পান না, এদিকে নিজের চ্যানেলে প্রাইম টাইম ডিবেটে বসে অর্ণব প্রশ্ন তোলেন- রাহুল গান্ধী অমুক সালে বেইজিং কেন গিয়েছিলেন? চীনের সাথে তার কি গোপন আঁতাত?

মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হলেই সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করলেন অর্ণব, বিরোধী দলের নেতাদের কটাক্ষ করা তো ছিলই। বেতন বাড়ানোর দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করলে তাদেরও অর্ণবের চ্যানেল থেকে 'অ্যান্টি ন্যাশনাল', 'পাকিস্তানী এজেন্ট', 'টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং', 'খান মার্কেট গ্যাং', 'আরবান নক্সাল' বা 'ইন্টেলেকচুয়াল জিহাদী' টাইপের নামে ট্যাগ দেয়া শুরু হলো। মুসলমানদের প্রতি ক্ষোভ আর ঘৃণা উগরে দেয়া শুরু করলেন অর্ণব, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হতে থাকলো রোজ। মার্চে তাবলিগি জামাতের মারকাজ থেকে করোনা সংক্রমণের খবরকে তিলকে তাল বানিয়ে পরিবেশন করেছেন অর্ণব, কাঠগড়ায় চড়িয়েছেন মুসল্লীদের ভারতের সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত বলেছে, মিডিয়াতে মারকাজ থেকে করোনা ছড়ানোর খবরকে ভুলভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল।

সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করে সবচেয়ে বড় ফায়দা ঘরে তুলেছেন অর্ণব গোস্বামীই। রিপাবলিক টিভি নামের যে চ্যানেলটার আংশিক মালিক তিনি, সেই চ্যানেল রীতিমতো উইচ হান্টে নেমেছিল রিয়া চক্রবর্তীর পেছনে। রিয়াকে খুনী বানিয়ে ছেড়েছেন অর্ণব, রিয়া যেদিন গ্রেপ্তার হলেন নারকোটিক্স ব্যুরোর হাতে, সেদিন যেন ঈদের আনন্দ লেগে গিয়েছিল রিপাবলিক টিভির স্টুডিওতে। ফ্যাক্ট রেখে একের পর এক প্রপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়েছে তিন-চার মাস ধরে, আজগুবি তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। সাংবাদিকতার রীতি-রেওয়াজের কোন ধারই ধরেনি এই চ্যানেলের সাংবাদিকেরা। সাংবাদিকতার জঘন্য মাত্রা বোঝাতে 'হলুদ সাংবাদিকতা' নামের একটা টার্ম ব্যবহার করা হয়। অর্ণব আর রিপাবলিকের ক্ষেত্রে হলুদ রঙটাও লাল হয়ে যাবে নিশ্চিত।

নিজের চ্যানেলে রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে উইচহান্ট চালিয়েছেন অর্ণব

স্টুডিওতে বসে গলির কুকুরের মতো ইচ্ছেমতো চিৎকার করেছেন অর্ণব গোস্বামী, বলিউড সেলিব্রেটি থেকে মুম্বাই পুলিশ বা মহারাষ্ট্র সরকার- যাকে খুশি তাকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন, পুরো বলিউডকে ড্রাগের আখড়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 'জাস্টিস ফর সুশান্ত' ক্যাম্পেইনের আড়ালে বাস্তবায়ন করেছেন নিজস্ব এবং তার প্রভুদের শিখিয়ে দেয়া এজেন্ডা। একই কাজ ভারতের সিংহভাগ টিভি চ্যানেলই করেছে, কিন্ত বাকীদের যোজন যোজন পেছনে রেখে এই নোংরামিতে চ্যাম্পিয়ন রিপাবলিক টিভি। ভারতে টেলিভিশন সাংবাদিকতার ইতিহাসে জঘন্য এক অধ্যায় হয়ে টিকে থাকবে যে চ্যানেলটা, টিকে থাকবেন অর্ণব গোস্বামীও।

তিনদিন আগে নিজের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অর্ণব গোস্বামীকে, এক ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার মামলায়। অন্বয় নায়েক নামের এক ডিজাইনার অর্ণবের রিপাবলিক টিভির অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছিলেন, তাকে তার পাওনা টাকা দেননি অর্ণব। সেই ভদ্রলোক ২০১৮ সালে একটা সুইসাইড নোটে অর্ণব সহ মোট তিনজনের নাম লিখে আত্মহত্যা করেন, এই তিনজনই তাকে দিয়ে কাজ করিয়েও তার পেমেন্ট দেননি, আর্থিক সংকটে ভুগছিলেন সেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনার।

নিজের প্রভাব এবং বিজেপির সঙ্গে লিয়াঁজো খাটিয়ে এই মামলাটা ধামাচাপা দিয়েছিলেন অর্ণব। কিন্ত মহারাষ্ট্রে এখন বিজেপির সরকার ক্ষমতায় নেই, আর অর্ণব বোকার মতো ক্ষমতায় থাকা শিবসেনা-কংগ্রেসকে অযথাই চটিয়ে দিয়েছেন উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে। প্রাইম টাইম ডিবেটে একজন উপস্থাপক যদি চিৎকার করে মুখ্যমন্ত্রী বা উপ-মুখ্যমন্ত্রীর নাম ধরে যা তা বলে যায়, একদিন না একদিন সে তো বিপদে পড়বেই। একবার ভাবুন, আমাদের দেশে কোন টেলিভিশন অ্যাঙ্কর কোন এমপি বা মন্ত্রীর নাম নিয়ে তুই-তোকারি ভাষা ব্যবহার করছে, সে তো আইনের ধারাতেই গ্রেপ্তার হবে, বাদবাকী হিসাব বাদ দিলাম। 

অর্ণব গোস্বামী

অর্ণব গোস্বামীর সাংবাদিকতার ধরণ এখন একটাই- গোয়েবলসীয় নীতি। একটা মিথ্যাকে একশোবার বলো, চিৎকার করে বলো, সেটাকে সত্যির মতো শোনাবে। সেটাই করে চলেছেন তিনি। টিআরপি স্ক্যামের অভিযোগেও তদন্ত চলছে অর্ণব এবং রিপাবলিকের বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগে খুব বেশিদিন এই লোককে জেলে আটকে রাখা যাবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অর্ণব যেমন এতদিন ভদ্রতার বালাই ভুলে যাকে তাকে আক্রমণ করেছে, এখন মুম্বাই পুলিশও অর্ণবের রেসিপি দিয়েই তাকে ঘায়েল করছে। বাস্টার্ডের সাথে খেলতে গেলে যে বাস্টার্ড হয়েই খেলতে হয়, সেটা মুম্বাই পুলিশ শিখে গেছে।

অর্ণব গোস্বামী খুব দ্রুতই মুক্ত হয়ে ফিরে আসবেন, বিজেপির নেতারা যেভাবে তার হয়ে লবিং করছেন, তাতে তাকে আটকে রাখাটা সম্ভব নয়। ভারতজুড়ে অনেকের এখন 'সাংবাদিকতার অধিকার' কিংবা ফ্রিডম অফ স্পিচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গৌরি লঙ্কেশ যখন সত্যি কথা বলার অপরাধে উগ্রবাদী হিন্দুদের হাতে খুন হন, তখন ফ্রিডম অফ স্পিচ ঘুমিয়ে থাকে। অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করার দায়ে যখন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হন, যখন তথ্য সংগ্রহ করত যাওয়া সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট লাগিয়ে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়, তখনও ফ্রিডম অফ স্পিচের কথা কারো মনে পড়ে না। কিন্ত অর্ণব গোস্বামী যেহেতু একটা পেইড প্রোডাক্ট- তার বেলায় এসব ভারী ভারী কথাবার্তা এসে হাজির হয়, ভারতের মন্ত্রী-এমপিরা তার হয়ে টুইট করেন। অর্ণবের মতো পুতুল সাংবাদিকেরা না থাকলে তো ক্ষমতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে যাবে তাদের জন্য...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা