দুজনে মিলে গান নিয়ে কত ভিন্নধর্মী গবেষণাই না করেছেন, একজন গান লিখেছেন, অন্যজন হয়তো তাতে সুর দিয়ে গেয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই তো তারা নিরীক্ষা করেছেন কত! বাংলা সঙ্গীত জগতে এমন জুটি আর কখনও আসেনি, কোনদিন আসবেও না, সেটা নিশ্চিত! 

ক্লাস ফোরে থাকতে আমরা ছড়া বেঁধে কোরাসে গাইতাম- ক্লাশ ফোর, হেডমাস্টারের জুতা চোর! আর সেই ক্লাস ফোরে থাকা অবস্থায় কিনা শায়ান চৌধুরী অর্ণবের মনটাই চুরি করে নিলেন সাহানা বাজপায়ী! সাহানা সেসব জানতেন না তখনও। তবে ভরা বর্ষার কোন একদিনে এক বন্ধুর মুখে যখন শুনলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অর্ণব নামের পিচ্চিটা বলেছে 'দেখিস, বিয়ে করলে আমি সাহানাকেই করবো', সেদিন আর ধৈর্য্যে কুলালো না ছোট্ট সাহানার। সোজা গিয়ে হেডমাস্টারের কাছে দিলেন নালিশ, তাও রেগেমেগে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে। খানিক পরেই অর্ণবেরও ডাক পড়লো সেখানে। বদ্ধ কামরার ভেতরে কি হয়েছিল আমরা জানিনা, তবে এটুকু আমরা জানি, অর্ণব তার প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন! 

শান্তিনিকেতনেই দুজনের দারুণ বন্ধুত্ব, ক্লাস ফোরের সেই ঘটনা তখন বেমালুম ভুলে গিয়েছেন হয়তো দুজনেই। বন্ধুত্ব থেকেই প্রেমের সূত্রপাত, শান্তিনিকেতনের ক্যাম্পাস জানে দুজনের প্রেমের গল্পটা। সেই প্রেমের একটা বড় অধ্যায় ছিল গান। সাহানা এখনও বলেন, অর্ণবের সাথে গান নিয়ে তার বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার, দুটো মানুষের মানসিকতা একই রকমের হলে যায় হয় আরকি। সাহানার লেখা প্রথম গানে সুর দিয়েছিলেন অর্ণব, সেই গানটা ছিল- 'একটা ছেলে মনের আঙিনাতে...' ছেলেটার নাম শায়ান চৌধুরী অর্ণব, সাহানার মনের আঙিনায় তিনি ততদিনে জায়গা করে নিয়েছেন ভালোভাবেই।

২০০১ সালে বিয়ে হলো দুজনের, সাহানা হয়ে গেলেন বাংলাদেশের মেয়ে। ব্যান্ডও গড়া হয়ে গেল। ব্যান্ডের পারফর্মের আগে মঞ্চে উঠে সাহানা শুনিয়ে দিতেন গোটাদুয়েক রবীন্দ্রসঙ্গীত, এটা তখন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। দুজনে মিলে গান নিয়ে কত ভিন্নধর্মী গবেষণাই না করেছেন, একজন গান লিখেছেন, অন্যজন হয়তো তাতে সুর দিয়ে গেয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই তো তারা নিরীক্ষা করেছেন কত! বাংলা সঙ্গীত জগতে এমন জুটি আর কখনও আসেনি, কোনদিন আসবেও না, সেটা নিশ্চিত! 

তবে সুখের দিনগুলো সইলো না। দুজনের রাস্তাটা আলাদা হয়ে গেল একটা সময়ে। ২০০৮ সালে অফিসিয়ালি বন্ধনমুক্ত হলেন দুজনে। সাহানা চলে গেলেন লণ্ডনে, সেখানে জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো তার। অর্ণবের জীবনও বদলে গেল এরপর থেকে। দশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে অর্ণব সাহানার আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে। সাহানার এখন একটা সংসার আছে, রোহিনী নামে ফুলের মতো ফুটফুটে একটা মেয়েও আছে তার, ইনস্টাগ্রামে সেই মেয়েটার ছবিও দেখি মাঝেমধ্যেই। অর্ণবও নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। কিন্ত অবাক করার মতো ব্যাপার কি জানেন? নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ওরা কখনও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেননি, অভিযোগের তীরে বিদ্ধ করেননি একে অন্যকে।

অর্ণব-সাহানা: ফেলে আসা দিনগুলোতে

সম্পর্কের সেই প্রথম সময়টাতে দুজন দুজনকে যতটা সম্মান করতেন, আজও ততটাই করেন। এখনও সাহানা যখন বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষাৎকার দেন, তখন উঠে আসে অর্ণবের কথা, অর্ণবের নামটা তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গেই উচ্চারণ করেন, সেখানে ফুটে ওঠে একজন বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা। সম্পর্ক নেই তাতে কি, শ্রদ্ধা, সম্মান, সবকিছুই আছে আগের মতোই অটুট। আবার অর্ণবও তার জীবনে, তার ক্যারিয়ারে সাহানার অবদানের কথা স্বীকার করেন অকুণ্ঠ চিত্তে।

তারা দুজন পরস্পরকে এখনও ভালো বন্ধু হিসেবে দাবী করেন, যদিও অনেকদিন ধরেই হয়তো তাদের দেখা হয় না, কথা হয় না, বন্ধুত্বের পোষাকী আবরণটাও হয়তো নেই সেভাবে। কিন্ত ওই যে, ঘৃণা ছড়ানোর খেলায় তারা মাতেননি কখনও। তারকা দম্পতিদের সম্পর্ক ভাঙলেই আমরা যেমন ব্লেম গেমের নেশায় মেতে উঠতে দেখি, তেমনটা করেননি তারা। তাদের ভালোবাসায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল, আজও আছে, নোংরামোকে তারা স্থান দেননি কোথাও, সম্পর্ক চুকেবুকে যাওয়ার পরেও না। 

সাহানার গানের সেই ছেলেটি হয়ে থাকা হয়নি অর্ণবের। অর্ণবও এখন অন্য কাউকে নিয়েই গান লেখেন। দুজনের ভক্তদের মনে এতে হয়তো আফসোস থাকতে পারে। তবে দুটো মানুষ নিজেদের মতো করে জীবন অতিবাহিত করছেন, নিজেদের রাস্তাটা স্বেচ্ছায় আলাদা করে নিয়েছেন, এবং কেউ অপরপাশের মানুষটার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করেননি। দুজনেই গানকে সঙ্গী করে নিজেদের পথে চলেছেন, সাহানা তো অর্ণবের সঙ্গীতায়োজনে গানও করেছেন 'আন্ডার কনস্ট্রাকশন' সিনেমায়। এই যে শ্রদ্ধাবোধ, পরস্পরের প্রতি সম্মান, তাতেই দুজনের সম্পর্কটা না থেকেও অন্যরকম এক মর্যাদা পেয়েছে। আজ অর্ণবের জন্মদিন, এই দিনে ভালোবাসার এই দুজন মানুষের জন্যে রইলো অফুরন্ত ভালোবাসা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা