শিল্পী শাহাবুদ্দিন এবং একাত্তরে একটি আর্ট এক্সিবিশন মিশন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্ট এক্সিবিশন করেছিলেন জঙ্গলের মধ্যে। শিল্পীর কাছে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেই আর্ট এক্সিবিশনের রোমঞ্চকর অভিজ্ঞতা যেমন ছিল...
মামুন রণবীর:
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তার জীবন নানা নাটকীয়তার ভরপুর। জীবনের প্রতিটি বাঁক তিনি ক্যানভাসে তুলে এনেছেন তুলির আঁচড়ে৷ তার জীবনবোধ নানা রঙে বর্ণিল। সেই বোধ থেকেই প্রতিটি আঁচড়ের জন্ম। একজীবনে যিনি ছবি আঁকাকেই ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্ট এক্সিবিশন করেছিলেন জঙ্গলের মধ্যে। শিল্পীর কাছে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেই আর্ট এক্সিবিশনের রোমঞ্চকর দিনের কথা শিল্পীর জবানিতে এমন -
"একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্ট এক্সিবিশন করেছি জঙ্গলে। কর্নেল শওকত যখন জানলো আমি আর্ট কলেজের ছাত্র, তখন আশ্চর্য হলেন। বললেন, আর্ট কলেজ! প্রথম কেউ বুঝে না আর্ট কলেজ কী। এরপর যখন ছবি আঁকা শুরু করলাম তখন আমার সম্মান বেড়ে গেল। তখন আমি প্লাটুন কমান্ডার। খালেদ মোশাররফ তখন আমাকে একুশ রুপি দিলেন। বললেন, আগরতলা থেকে রং-টং কিনে নিয়ে এসো।" সেই উত্তাল দিনে অনেকদিন ছবি আঁকার অনুশীলন ছিল না। ছিল না ছিল না রঙ, তুলি, কাগজ।তাই প্রথমে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য মনের জোরে কাজ চালিয়ে গেলেন। "প্রশিক্ষণ নেই। আঁকতে পারি না।আমি যে শিল্পী হবো, জীবনেও ভাবি নাই।"
একদিন ছুটি নিয়ে তিনি আগরতলায় গেলেন। জঙ্গল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। আর্টের কাগজ, রং খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলেন। প্রচন্ড ক্ষুধায় কলা-চিড়া কিনে ফিরলেন নিজেদের ক্যাম্পে। তার ভাষায় - "যুদ্ধের সময় খাবারের খুব কষ্ট পাইছি আমরা। জঙ্গলে বড় বড় জোঁক ছিল । হেবি লাফ দিয়ে আসে। শরীর খালি পাইলেই হলো। কাপড় পরলে অবশ্য আসে না। ম্যাক্সিমামের গায়েই তো বেশি কাপড় নাই। লুঙ্গি পরা। আমি একটা প্যান্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। এই জন্য সবাই আমাকে ডাকত মাঞ্জা প্লাটুন কমান্ডার। ট্রেনিংয়ে সবাই পরত লুঙ্গি-গামছা। মূলত সবাই লেংটি দিয়ে রাখত।"
এক্সিবিশনের জন্য অনেক খুঁজে শাহাবুদ্দিন কিছু ক্যালেন্ডার যোগাড় করলেন৷ রঙ না পেয়ে চোখের কাজল কিনলেন। এরপর কাজল,সবজির আঠা একসাথে মিশিয়ে রঙ তৈরি করলেন। আঁকলেন বঙ্গবন্ধুর একটি পোর্ট্রেট। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সকাল থেকে ট্রেনিং হয় বিকেল পর্যন্ত। তারপর অবসর। সেই সময়ে অনেকে গান করে,নিজেদের চাঙ্গা করে। শাহাবুদ্দিন ছবি আঁকতে লাগলেন।

"কাগজের উপর কয়লা, হারিকেনের সলতের কালো রং এইগুলো দিয়ে ছবি আঁকলাম। মাথায় আইডিয়া এলো। এইসব আর প্লাস্টিকের তাঁবু দিয়ে তো ওয়াল বানাতে পারি। কিছু কিছু গাছ কেঁটে একটা স্পেস করে বেড়ার মতো বানালাম।" সংগীত শিল্পী আজম খান ছিলেন একই ক্যাম্পের সতীর্থ।তারা একসাথে যুদ্ধ করেছেন। সমস্বরে যুদ্ধের গান গেয়েছেন। একসাথে আরো কতো স্মৃতি। "আজমকে বললাম, তুমি গান গাবা আর আমি ওপেনিং করব। তখন খালেদ মোশাররফ বলল, একটা অনুষ্ঠান করা যাক। আমি সব আয়োজন করব। ত্রিপুরা সরকারের সবাই আছে।
আজম লিডিং নিল। হারমোনিয়াম আসলো মেলাঘর থেকে। আমার প্রিপারেশন হলো বাঁশ দিয়ে আর্ট গ্যালারি বানানো। গাছ দিয়ে স্টেজ তৈরি হলো। সব প্লাস্টিকের তাঁবু। জাম্বুরার কাঁটা দিয়ে দিয়ে ছবিগুলা লাগিয়েছি প্লাস্টিকে ছিদ্র ছিদ্র করে করে।সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হবে। চারটি রুম তৈরি করেছি। এক সাইড খোলা রেখেছি। ওই দিকে সব জনতা ও সোলজার। আর সামনে চেয়ারে বসে ছিলেন ত্রিপুরার মন্ত্রীগণ, খালেদ মোশাররফ ও অন্যরা।"
প্রায় ৩ হাজার লোকের সমাগম ঘটলো। অনুষ্ঠানে গান শুরু হলো। স্টেজের উপর কয়েকজন টর্চ লাইট ধরলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবিটা রশি দিয়ে গাছের উপর টানানো হলো। অনেকটা পতাকার মতো করে। "কেউ কল্পনাও করে নাই, এই জঙ্গলের মধ্যে ছবির এক্সিবিশন। আর যারা চেয়ারে বসে ছিলেন, লাইট-টাইট জ্বালার পরে দেখেন, একি ব্যাপার। এবার বঙ্গবন্ধুর ছবির ওপর জ্বালানো হলো বড় টর্চ লাইট। সাথে সাথে জয় বাংলা স্লোগানে পুরো জঙ্গল যেন কেঁপে উঠল। সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল। সবার চোখ ছলছল করছে- গর্বে, আনন্দে।”
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন