অরুণ কুমার বসাকের মতোই যদি হতেন সব শিক্ষক...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এখনকার শিক্ষকরা পড়াবেন কি, লাল নীল সাদা দলের রাজনীতি করেই সময় পান না, নিজের ক্লাস রেখে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট ক্ষেপ মারেন। গবেষণা করবেন কি, নকল করেই কুল পান না। সেই জায়গায় অরুণ কুমার বসাক স্যার ভীষণ দূর্লভ এক শিক্ষক, যার জন্য শ্রদ্ধাটা আসে এমনিতেই, আপনমনে।
বাংলাদেশে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে একমাত্র এমিরিটাস অধ্যাপক তিনি। একই সাথে একজন পদার্থবিজ্ঞানীও বটে। মানুষটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বরেণ্য শিক্ষক অরুণ কুমার বসাক। আজকে একজন অনুকরণীয় শিক্ষকের খোঁজে আমাদের হাপিত্যেশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষক বাণিজ্য হয়, কোনো নিয়ম নীতি ছাড়াই যারা শিক্ষক হন এখানে তাদের পারফর্মেন্সও হতাশাজনক। তাদের ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার জন্য এটেন্ডেন্সের ব্যবস্থা, না এলে জরিমানা অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই একসময় এমন শিক্ষক ছিলেন যাদের ক্লাস করার জন্য অন্যান্য বিভাগ থেকেও ছাত্ররা এসে হাজির হতো, জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে ক্লাস করত।
এখন এমন শিক্ষক কোথায়? আছে হয়ত হাতে গোনা, খুব বেশি নয়৷ অরুণ কুমার বসাক স্যারকে দেখে মনে হলো, আরেহ এমন একজন শিক্ষককেই তো মনে মনে খুঁজেছি এতদিন! বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একজন শিক্ষক পেলে হয়ত পড়ালেখার আনন্দটুকু বুঝতে পারতাম, উপলব্ধি করতে পারতাম জ্ঞ্যানঅর্জনের আনন্দ কাকে বলে! সম্প্রতি অরুণ কুমার বসাক স্যারের একটা ভিডিও ফেসবুকে দেখতে পাই৷ দেখে ভীষণ ভাল লাগে। মনে হলো, স্যারের কথা লিখে রাখা দরকার। বয়স এখন তার প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই৷ অথচ, কথা একটুও জড়িয়ে যায় না।
বাচনভঙ্গির একটা স্বতন্ত্র ধরণ আছে স্যারের, মনে হয় গল্প বলছেন একদম ডালপালা মেলে, এত সুন্দর। এই বয়সে এসেও স্যারের কাজ ফুলটাইম শিক্ষকতাই করা, গবেষণার কাজে ল্যাবে সময় দেয়া। তিনি আসলে আগাগোড়া বোধহয় একজন শিক্ষকই হতে চেয়েছিলেন, তাই এত কঠিন পরিশ্রম করেছেন জীবনজুড়ে। আজকাল যা বিরল, এখনকার শিক্ষকরা পড়াবেন কি, লাল নীল সাদা দলের রাজনীতি করেই সময় পান না, নিজের ক্লাস রেখে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট ক্ষেপ মারেন। গবেষণা করবেন কি, নকল করেই কুল পান না। সেই জায়গায় অরুণ কুমার বসাক স্যার ভীষণ দূর্লভ এক শিক্ষক, যার জন্য শ্রদ্ধাটা আসে এমনিতেই, আপনমনে।
জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালে। এখনো ছুটে চলছেন তিনি, বার বার তার পুনর্জীবন হয় নতুন কিছু শিখার মাধ্যমে। তার কাছে মনে হয়, কোনো একটা কিছু গভীরভাবে শেখার যে আনন্দ তার সাথে তুলনীয় কিছু হতে পারে না। এটা যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা। পড়ালেখার মধ্যে এই আনন্দটুকু তার মধ্যে এসেছিল, কারণ তিনিও জীবনে এমন একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যে শিক্ষক পড়ার আনন্দটুকু ধরিয়ে দিতে পেরেছেন তাকে। অরুণ কুমার বসাক স্যারের সেই শিক্ষক যার মতো শিক্ষক তিনি নাকি বিলাতেও পাননি, সেই মানুষটার নাম মাখনলাল চক্রবর্তী।
মাখনলাল তাকে একটা কথাই বলতেন, যা শিখো তা কি ভিজুয়ালাইজ করতে পারো? সারাদিন যা পড়ো দিনের শেষে কোনো নির্জনে বসে সেটাকে চোখের সামনে দেখার চেষ্টা করো। যদি দেখতে পাও, তাহলেই বুঝবে তুমি কিছু শিখতে পারছো! যদি না পারো, তাহলে আবার পড়ো, তারপর আবার ভাবো। এই টেকনিকটা তিনি আজীবনই কাজে লাগিয়েছেন। এডওয়ার্ড কলেজের একটা ঘটনা দেখে বোঝা যায় তার মেধার ধার কতখানি। পরীক্ষার হলে একদিন তার খাতা থেকে দেখে লিখছিলো একজন, সেই ছেলের খাতা দেখে লিখছিলো আবার আরেকজন। শিক্ষক এসে তিনজনের খাতাই নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার তখনো এক ঘন্টা বাকি। শিক্ষক হুমকি দিয়ে গেলেন, পরীক্ষা এক্সপেল হয়ে যাবে এই তিনজনের। খাতা আর ফেরত পাননি সেদিন।
অরুণ কুমার বসাক তখন রীতিমতো ভয় পেলেন। এই পরীক্ষা এত খারাপ গেল, ভাল ফল কি আর আশা করা যাবে। যাহোক রেজাল্টের দিনের কথা। তিনি দূরে চুপচাপ বসে আছেন। রেজাল্ট দেখার জন্য তাড়াহুড়ো নেই। কি হবে দেখে এমন একটা ভাব। একবার দেখতে গেলেন, গিয়ে দেখলেন তার সাথের বাকি যে দুইজনের খাতা নিয়েছে টিচার, তাদের রেজাল্ট সেকেন্ড ক্লাস। কিন্তু তার রেজাল্ট নাই কোথাও৷
তিনি তো আরো হতাশ হলেন। এরই মধ্যে মাইকে স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের ফলাফল ঘোষণা করা শুরু হলো। প্রথম হয়েছে যশোর কলেজের একটা ছাত্র, দ্বিতীয় হয়েছে এডওয়ার্ড কলেজের অরুণ কুমার বসাক। তিনি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু এটাই সত্যি, এক ঘন্টা আগে খাতা নেয়ার পরেও অরুণ কুমার বসাক বোর্ড স্ট্যান্ড করেছেন। কি পরিমাণ পরিশ্রম করলে, একজন ছাত্রের খাতায় তার প্রতিফলন ঘটে সেটাই আসলে প্রমাণিত হয়েছে অরুণ কুমার বসাকের ফলাফলে।
যাহোক, স্বাধীনতার পর বার্মিংহাম থেকে পিএইচডির জন্য ডাক পেলেন। পিএইচডি ছাত্রদের মধ্যে তার বয়সই সবচেয়ে বেশি। তার উপর তার আবেদন দেরিতে পৌঁছানোর কারণে তিনি নিজের বিষয়ে পিএইচডি পাননি, পেয়েছিলেন এক্সপিরিমেন্টাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। তিনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ ছিল না তার জন্যে৷ প্রথম দিকে কেউ পাত্তা দিত না তাকে। বাকিরা কি তরতর করে বুঝে ফেলত, কিন্তু অরুণ প্রথম দিকে ধরতে পারতেন না কি বলছে স্যাররা। তার মনে উদ্বেগ হলো, তিনি কি নিজের নাম, বাংলাদেশের নাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখতে পারবেন না? উল্লেখ্য তখন তিনি দেশ ছাড়ার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। অরুণ কুমার বসাকের মনে পড়লো, মাখনলাল স্যারের কথা। তিনি ঠিক করলেন, অন্যরা দশ মিনিটে যা বুঝে, তিনি সেটা বুঝতে প্রয়োজনে দুই ঘন্টা ব্যয় করবেন।
তারপর শুরু হলো তার স্টাইলে পড়ালেখা। নয় মাস, বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাব, বাসা এর বাইরে কিছুতে যেতেন না, মনও পড়ে থাকত পড়ায়। কারণ, এটাই তার লড়াই। এর ফলাফল কি হলো? অরুণ কুমারকে তার সুপারভাইজার ডেকে নিয়ে চা খাওয়ালেন, এবং পিঠ চাপড়ে বললেন, তুমি কি করেছো জানো? তুমি প্রথম হয়েছো সবার মধ্যে! তারপর পরীক্ষার খাতা অরুণকে দিয়ে বললেন, রেখে দাও তোমার কাছে, দেখিয়ো তোমার পরবর্তী জেনারেশনকে, কি করে গেছো তুমি! এই এচিভমেন্ট দেখে নিশ্চয়ই গর্বিত হবে সবাই। অরুণ কুমার বসাক স্যার এখন বাংলাদেশে ফিজিক্সের একমাত্র এমিরিটাস অধ্যাপক।
তার প্রভাব এতটাই যে, তার দেখাদেখি এখন অনেক উঠতি শিক্ষকও গবেষণায় উদ্যোগী হচ্ছে। কোয়ালিটি যাই হোক, চেষ্টা আছে অন্তত। কারণ, তারা চোখের সামনে সারাদিন দেখেন একজন পরিশ্রমী অরুণ কুমার বসাককে, যিনি নিরলসভাবে চেষ্টা করে যান নতুন কিছু আবিষ্কারের, নতুন কিছু জানার। এ পর্যন্ত অরুণ কুমার বসাক ৫৫ টি এম. এস. সি, ২ টি এম.ফিল এবং ৬ জন পি এইচ ডি রিসার্স পেপার তত্বাবধায়ন করেছেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জার্নালে তার ১৩৯ টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে ৮৬ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে ২৫ টি দেশীয় জার্নলে এবং বাকি গুলো বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়!
অরুণ কুমার বলেন না কাউকে পড়তেই হবে, ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। তার কথা খুব সাধারণ। যা তুমি পড়ো নিজে নিজে পড়ো, বুঝো, ভাবো, ওটাকে নিজের মতো করে শিখো। নকল করা যাবে না। তুমি যেটাই করছো, সেটা মন দিয়ে করতে থাকো। পরিশ্রম করলে এমন কিছু নেই যে অর্জন করা অসম্ভব। সব কিছু ভুলে টুলে যা থেকে যায় আমাদের সাথে সেটাই জ্ঞ্যান।
আমাদের এই জ্ঞ্যান অর্জনের দিকটাই দেখতে হবে। যখন জ্ঞ্যান অর্জনের আনন্দটুকু আমরা পেতে শিখব, তখন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য আমরা অর্জন করতে পারব। ভালকে ভাল, খারাপকে খারাপ বলে চিনতে পারব। দ্বিধাহীন ভাবে নিজের মতামত জানাতে পারব, চাপিয়ে দেয়া মতামত নয়। অরুণ কুমার বসাক স্যারের মতো এমন শিক্ষক যদি সব বিভাগে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকত, তাহলে ছাত্ররা অন্তত জানত আসলে কি শিখতে হবে।
কিন্তু আজকের দিনের শিক্ষকরা কতটুকু অনুপ্রাণিত করতে পারেন শিক্ষকদের, লেকচারের বাইরে, রেজাল্টের ভয়ভীতি, ক্যারিয়ারের ভয়ভীতি দেখানোর বাইরে কয়টা জীবনঘনিষ্ট কথা বলেন, কয়টা কথা বলেন যা থেকে জীবনকে আলাদা চোখে দেখা যাবে? আমাদের অরুণ কুমার বসাক স্যারের মতো আরো শিক্ষক দরকার, পড়ালেখা বোঝা নয়, আনন্দও হতে পারে এই বোধটা যে পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি। সেই বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য আলোকবর্তিতা হাতে উদয় হোক আরো অনেক অনেক অরুণ কুমার বসাকের...