অশোক কুমার দেখিয়ে দিয়েছেন, সাফল্য অর্জনের পথে বয়স কোন বাধা নয়। ৪৭ বছর বয়সে কপর্দকহীন অবস্থা থেকে প্রায় ৫০০০ কোটি রূপির মালিক হয়েছেন তিনি, সবটাই অধ্যবসায়ের ফল!

বেশিরভাগ জীবনসংগ্রামের কাহিনীই শুরু হয় একেবারে অল্প বয়স থেকে। সফল ব্যক্তিদের অতীতের দিকে যদি তাকাই আমরা, জীবনের শুরু থেকেই পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন তারা। এটি অবশ্য খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। মানুষের যখন বয়স থাকে, রক্তে থাকে টগবগে তারুণ্যের চাঞ্চল্য, প্রবল ইচ্ছা আর উদ্দাম জীবনীশক্তি, তখন খুব সহজেই তারা বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে চলতে পারে। তখন তারা সহজে হতাশ হয় না, কিংবা হলেও একসময় সেইসব হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন করে ছুটে চলা শুরু করতে পারে। 

কিন্তু জীবনের অর্ধেক কিংবা তারও বেশি কাটিয়ে দেয়া, মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কি এই কাজটি এতটাই সহজ? বয়সের ভারে একে তো তারা ন্যুব্জ হয়ে পড়েই, সেই সাথে তাদের ঘাড়ের ওপর বর্তে থাকে সমাজ সংসারের অজস্র চাপও। সেই সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে তাদের জন্য কি নতুন করে সবকিছু শুরু করা সম্ভব?

নবীন দেহে নবীন প্রাণ সঞ্চার করা যতটা সহজ, প্রবীণ দেহে তো তা নয় মোটেই। তাই মধ্যবয়সে বড় কোন ধাক্কা খেলে অধিকাংশ মানুষের জন্যই সেটির পরিণতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। কিন্তু আজ এমন এক মানুষের কথা বলব, যিনি সেই আপাত অসম্ভব কাজটিকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। 

যার কথা বলছি, তিনি অশোক কুমার। তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান, যে পরিবারটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ব্যবসার সাথে যুক্ত। 'সোনা কোয়ো স্টিয়ারিং' নামে গয়নার ব্যবসার মালিক তাদের পরিবার, যেটি যাত্রা শুরু করেছিল সেই ১৮৮৯ সালে। এবং বংশ পরিক্রমায় একসময় অশোকও সেই ব্যবসার সাথে যুক্ত হন।

শুরুর দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। যৌবন ও মধ্যবয়সের প্রায় অনেকটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিজেদের পারিবারিক এই ব্যবসাকে শুধু টিকিয়েই রাখতে নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে। কিন্তু ১৯৯৩ সালে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারার সময় দেখা গেল, অন্যান্য সম্পত্তির পাশাপাশি ব্যবসার সিংহভাগই পেয়েছেন তার ভাই। সেই মুহূর্তে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে ৪৭ বছর বয়সী অশোকের। যে ব্যবসার পেছনে তিনি জীবনের এতটা সময় ব্যয় করেছেন, সেটিই কিনা তার আর নিজের থাকল না! 

কী করবেন না করবেন, কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না অশোক। তার কাছে নতুন করে সবকিছু শুরু করার মত পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। ছিল শুধু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, আর কঠোর পরিশ্রম করতে পারার মত মনোভাব। কিন্তু ৪৭ বছর বয়সে কেবল এই দুইটিকে সম্বল করে কি সামনে এগোনো যায়? উত্তরটি যে ইতিবাচক, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন অশোক।

আজকালকার তরুণ-তরুণীরা ২৩-২৪ বছর বয়সে যা করে, অশোক তা করলেন তাদের দ্বিগুণ বয়সে এসে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে একদম শূন্য থেকে শুরু করলেন সবকিছু। প্রথমে তিনি ভেবেই পাচ্ছিলেন না একজন উদ্যোক্তা হিসেবে এমন কোন জিনিস নিয়ে কাজ করা যায়, যেটি এখনও খুব বেশি মানুষ করছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে যার অপার সম্ভাবনা আছে?

ঘন্টার পর ঘন্টা একনাগাড়ে ভেবে, রাতের পর রাত জেগে তেমন একটা কিছুর সন্ধান পেলেন তিনি। খুলে বসলেন 'কৃষ্ণ মারুতি লিমিটেড', যাদের কাজ হবে জাপানি অটো জায়ান্ট 'সুজুকি'কে গাড়ির সিট সরবরাহ করা। কিন্তু এই ব্যবসায় অশোকের শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। প্রথম বয়সেই তাকে মোকাবেলা করতে হয় এক ভয়াবহ শ্রমিক ধর্মঘটের। সেই সময়ে দিনের পর দিন তিনি কারখানায় রাত কাটান শ্রমিক নেতাদের সাথে বসে সমস্যার সমাধান করতে। যদিও বা এক পর্যায়ে সেই সমস্যা মিটে যায়, কিন্তু তখন সামনে আসে নতুন আরেকটি সমস্যা।

মানসম্পন্ন না হওয়ায় ১১ লক্ষ রুপি মূল্যমানের গাড়ির সিট নাকচ করে দেয় 'সুজুকি'। ব্যবসায়ের প্রথম বছরেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান দেয়ায় বড় বিপদে পড়ে যান অশোক। কিন্তু এত এত বাধার সম্মুখীন হয়েও ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং শক্ত হাতে একাই সবকিছু সামাল দিতে থাকেন। দিনে ১৮-২০ ঘন্টাও কাজ করতে থাকেন তিনি। তার ব্যবসা যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেননি তিনি। এবং বাস্তবিকই এক সময়ে তিনি এসবের প্রতিদান পেতে শুরু করেন।

তার কোম্পানিই সর্বপ্রথম সর্বোচ্চ গুণগত মান অটুট রাখার জন্য গাড়ির সিট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডেমিং প্রাইজ জিতে নেয়। এবং গাড়ির সিটের গুণগত মানের উন্নতির সাথে সাথে তার ব্যবসার প্রসারও হতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে বাজার দখল করে নিতে সক্ষম হন তিনি। ২০০৫ সালে তার কোম্পানি 'মার্ক অটো' কিনে নেয়, আর তিনি এর নতুন নামকরণ করেন 'স্যাট কৃষ্ণ হনুমান মেটালস'।

অন্য কেউ হলে হয়ত এখানেই থেমে যেত। কিন্তু অশোক তা করেননি। গাড়ির সিট প্রস্তুতের ব্যবসায় সর্বোচ্চ সাফল্য লাভের পর তিনি অন্যান্য আরও নানা খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। এবং সেসব বিনিয়োগের অধিকাংশই তার জন্য লাভজনক হিসেবে প্রমাণিত হয়। এভাবে বর্তমানে বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছে তার নাম।

যেভাবে দুই হাতে অর্থ উপার্জন করছেন অশোক, তেমনি সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেয়ারও দায়বদ্ধতা অনুভব করেন তিনি। আর সেজন্যই একের পর এক নির্মাণ করে চলেছেন স্কুল, কলেজ, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, এতিমখানা, হাসপাতাল ইত্যাদি। পাঠক নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন, ৪৭ বছর বয়সে হঠাৎ করে কপর্দশূন্য হয়ে পড়া একজন ব্যক্তির জন্য ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, সে কথা চিন্তা করাও কতটা কঠিন ছিল। কিন্তু অশোক সেটিই করে দেখিয়েছেন। তাহলে ভেবে দেখুন তো, অশোক যদি ৪৭ বছর বয়সেও ব্যর্থতা মেনে না নিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারেন, (ধরে নিচ্ছি এই লেখার অধিকাংশ পাঠকই তরুণ) আপনারা তার থেকেও অনেক কম বয়সী হয়েও কেন অল্পতেই হাল ছেড়ে দেবেন, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবেন?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা