আপার জন্য মৃত্যুদূতকে আলিঙ্গন করেছিলেন তাঁরা...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
প্রিয় নেত্রীকে একটিবার সামনাসামনি দেখবেন, কাছ থেকে দেখবেন সেই আশায় গিয়েছিলেন সেদিনের সমাবেশে। শেখ হাসিনাকে দেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু এটাই ছিল তাঁর শেষ দেখা।
তাঁর নাম ছিল রফিকুল ইসলাম। তিনি নাকি সবসময় আওয়ামীলীগের সমাবেশে উপস্থিত থাকতেন আর সমাবেশের শেষে নেতাকর্মী, উপস্থিত সাংবাদিকদের 'আদা' খাওয়াতেন! সবাইকে দেয়া শেষ হলে তিনি আদা নিয়ে যেতেন প্রিয় আপা শেখ হাসিনার কাছে। এজন্য সবাই তাঁকে 'আদা চাচা' বলেই ডাকতো! সেদিনও বঙ্গবন্ধু ২৩ এভিনিউতে তিনি আদা নিয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আদা নিয়ে যখন তাঁর প্রিয় আপার কাছে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। সবার প্রিয় আদা চাচার রক্তাক্ত দেহটা মঞ্চের ঠিক পাশেই পড়েছিল।
নারায়ণগঞ্জের ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী আব্বাসউদ্দীন শিকদার ওরফে রতন শিকদার। এই মানুষটাকে নাকি আওয়ামীলীগের মিছিল মিটিং হলে একেবারেই বেঁধে রাখা যেত না। সবসময় মিছিলের আগে থাকতেন, জুয় বাঙলা স্লোগান ধরতেন। সেদিন সমাবেশে যাওয়ার আগে মমতাময়ী মা মমতাজ বেগমকে বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরবেন। কিন্তু আর ফেরা হলো না।
রতন শিকদার হয়তো মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন শেখ হাসিনাকে। তাঁর রক্তাক্ত শরীর যখন হাসপাতালের পথে ছিল, তখন বারবার তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন কিনা! একথা বলতে বলতেই একসময় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকায় উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে এসেছিলেন পটুয়াখালীর মামুন মৃধা। শেখ হাসিনা নামটার প্রতি ছিলেন যুক্তিহীন দুর্বল। প্রিয় নেত্রীকে একটিবার সামনাসামনি দেখবেন, কাছ থেকে দেখবেন সেই আশায় গিয়েছিলেন সেদিনের জঙ্গী বিরোধী জনসমাবেশে। শেখ হাসিনাকে দেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু কে জানতো অকালে ঝড়ে যাওয়া মামুনের সেদিনই শেখ হাসিনাকে প্রথম এবং শেষবারের মতো দেখা হবে।
ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ। তিনি মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী। সেদিন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিলো সুধাসদনে পৌঁছাতে। রাগ করলেন শেখ হাসিনা, বকাও দিলেন। তিনি বললেন, আজ আর আমার সাথে যাওয়া লাগবে না। মাথা নিচু করেই ক্ষমাপ্রার্থী হলেন মাহবুব, শেখ হাসিনার পিছু নিয়ে সমাবেশেও হাজির হলেন। একের পর গ্রেনেড বিস্ফোরণ শেষ হওয়ার পর সবাই যখন শেখ হাসিনাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে তৎপর, শেখ হাসিনা তখন চেঁচিয়ে উঠলেন, 'আমি যাব না!' মাহবুব জোর করেই শেখ হাসিনাকে গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যান। হঠাৎ শুরু হল গুলিবর্ষণ! একটা গুলি এসে লাগলো মাহবুবের মাথায়! প্রিয় নেত্রীকে গাড়িতে তুলে দেয়ার পরই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মাহবুবুর রশীদ। সেদিন জীবন দিয়ে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে ছিলেন যিনি!
রক্তাক্ত ২১ শে আগস্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালো দিন, একটি কালো অধ্যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেদিন আরো একটি ১৫ আগস্ট ও তার পরবর্তী প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। গ্রেনেড হামলার পরে, গুলিবর্ষণ। সবকিছুকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানব দেয়াল তৈরি করে তাদের প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করেছিলেন সেদিন। আইভী রহমান, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদারসহ আরো ২৪ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন সেদিন।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের ২০ তম জাতীয় সম্মেলনে, নিজ বক্তব্য দেয়ার মুহুর্তে বারবার বলেছেন, 'আওয়ামী লীগের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস। এই দল এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে। পৃথিবীতে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যারা আওয়ামী লীগের মতো ত্যাগ স্বীকার করেছে।' ৭৫ থেকে ৯৬ প্রায় একুশ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে যেভাবে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, কেউ কি ভেবেছিল যে স্বাধীনতা সংগ্রামকে নেতৃত্বদানকারী এই দল একুশ বছর পরে হলেও ক্ষমতায় আসবে! এই দল মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? হয়তো কেউ ভাবেনি। কিন্তু কি অদ্ভুত, এই দল ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সকল ষড়যন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। এই দল দুর্যোগ মোকাবেলা করতে জানে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ ও মতে ভিন্ন পার্থক্য থাকলেও এমন সময় ছিল যখন সবদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, মানবতা তথা এক অর্থে আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে এদেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
কিন্তু বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে ভয়াল ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড বোমা হামলার পরে, সেই রাজনৈতিক সম্পর্কের চিরতরে অবসান ঘটে। অনেকাংশে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও চিড় ধরে। প্রতিহিংসার রাজনীতি এদেশে বরাবরের মতোই ছিল, কিন্তু ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার জন্য উন্মাদ হয়ে বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণ করে সেই সময়ের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার যে অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিলো তা অতীতের সকল প্রতিহিংসাকে ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতায় অমানবিক ও ঘৃণ্য রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। বঙ্গবন্ধু ২৩ এভিনিউতে তাজা প্রাণের লাশের স্তূপ বানানোর পর সংসদে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হাস্যরস করে রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে ধুলিস্যাৎ।
বেগম জিয়া জাতীয় সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে তামাশার সহিত বলেছিলেন, “ওনাকে মারতে যাবে কে? শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।” রক্তমাখা পাঞ্জাবী গায়ে দক্ষ ও প্রবীণ পার্লামেন্টেরিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে গেলে, তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হয়। বারবার বক্তব্যের সুযোগ চেয়েও স্পিকার তাঁকে কোনো ফ্লোর দেননি। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতি ও গনতন্ত্রকে চূড়ান্তভাবে নেতিবাচক ও ঘৃণ্য রূপ দেয়ার দায় এবং পরিচয় বিএনপিকে সবসময় বহন করে চলতে হবে। আজ ইতিহাসের হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও, বিএনপির রাজনৈতিক নাজুক অবস্থাই প্রমাণ করে যে ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। বরং প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে বারবার ফিরে আসে!
২১ শে আগস্ট দিনটি প্রমাণ দিয়ে যায় একটি আদর্শকে ধারণ করার। অনেকে সেদিন আহত বা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়েছিলেন। আজও শরীরে স্প্রিন্টারের ক্ষত বয়ে বেড়ান অসংখ্য মানুষ! সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহতদের নিয়ে যাওয়ার পর, ন্যূনতম চিকিৎসা পর্যন্ত পাননি। অথচ আজও কারো কোনো অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই। শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন, সেই তৃপ্তির ঢেকুরের চেয়ে বড় প্রাপ্তি যেন কিছুই নেই তাদের কাছে। জানি না, আওয়ামী লীগ এর নেতারা এসকল ত্যাগীদের কতটুকু খোঁজ রাখেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ এসব মানুষদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে, থাকবে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন