জন্ম থেকে হাত-পা নেই। মুখের সাহায্যে ভর দিয়ে, এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বস্তাভর্তি ধানের সঙ্গে তুলনা করে ভর্ৎসনা করেছেন প্রধান শিক্ষক। একজন শিক্ষক যদি এমন আচরণ করেন, তবে সমাজের বাকীরা কেমন করবে?
প্রতিবন্ধী। শব্দটি এমন এক মানসিক ও শারীরিক সীমাবদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় যা নিয়ে মজা কিংবা অবহেলা করা মানায় না। দুষ্টুমির ছলে বন্ধুরা একে অপরকে প্রতিবন্ধী বলার একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যায় আমাদের মধ্যে। প্রতিবন্ধী শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করি আমরা। ব্যাপারটি কী এতোটাই ঠুনকো? নাকি আমরাই বুঝতে অক্ষম?
আমরা যতোটা সহজভাবে হেসে উড়িয়ে দেই, প্রতিবন্ধীদের জীবন ততোটাই কঠিন। কতো প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে তাদের এগিয়ে চলতে হয় সে খেয়াল কি আমাদের আছে? কোথাও চলাচল করা থেকে শুরু করে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র কোথাও নিস্তার নেই তাদের। পদে পদে প্রতিবন্ধতা। যখনই এসব এড়িয়ে কেউ সামনে এগিয়ে যেতে চায় আমরা তাকে পেছন থেকে টেনে ধরি।
লিতুন জিরা। জন্ম থেকে নেই হাত-পা। মুখের সাহায্যে ভর দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এভাবেই, যশোরের মণিরামপুরের অদম্য মেধাবী এই শিক্ষার্থী এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার প্রবল ইচ্ছা ছিল মণিরামপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। সে অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর মা বাবার সাথে হুইল চেয়ারে করে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে আসে।
লিতুনের সিট পড়ে দোতলার একটি কক্ষে। প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে উপরে উঠতে কষ্ট হবে জানিয়ে নিচের যেকোনো কক্ষে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে প্রধান শিক্ষক হায়দার আলীকে অনুরোধ করেন লিতুনের মা বাবা। এ অনুরোধ করতেই প্রধান শিক্ষক হায়দার আলী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক লিতুনের সামনে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মেয়েকে কোলে নিয়ে উপরে যান। বস্তাভর্তি ধান যদি নাড়াচাড়া করা যায়, তাহলে তাকে নিয়ে উপরে উঠতে সমস্যা কোথায়? পঙ্গু মেয়ের জন্য পৃথক কক্ষে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। অন্য স্কুলে ভর্তি করার পরামর্শ দেন লিতুনের মা বাবাকে।’
প্রধান শিক্ষকের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে লিতুন ও তার বাবা মা হতবাক হয়ে অঝরে কাঁদতে থাকেন। উপায়ান্ত না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তারা দুজনে কষ্ট করে লিতুনকে দোতলায় পরীক্ষার কক্ষে বসিয়ে দেন। পরীক্ষা অংশ নিয়ে লিতুন মেধার স্বাক্ষরও রাখেন। সে কৃতিত্বের সাথে ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়। লিতুন জিরা আক্ষেপ নিয়ে জানায়, ‘প্রধান শিক্ষক যদি তার সাথে এমন আচরণ করেন, তাহলে সহপাঠীরা তার সাথে কি আচরণ করবে?’
প্রধান শিক্ষকের সেদিনের আচরণের পর লিতুনকে সরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য রাজি করানো যায়নি। এ আচরণের প্রতিবাদে, ঐ সরকারি স্কুলে ভর্তি না হয়ে উপজেলার গোপালপুর স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। এই পর্যন্ত এসে, আর কথা বাড়ানোর রুচি হচ্ছে না। শুধু একটি প্রশ্ন রেখে গেলাম, প্রতিবন্ধী হওয়াটা কী অপরাধ নাকী পাপ?