
আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আমার বোন মারা যায়।আমার বোনটা যে কতটা অসহায় বোধ করছিল তখন মায়ের ডাক শুনছে তবুও না দিতে পারছে উত্তর না পারছে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতে!
দুইদিন ধরে ভাবছিলাম কিছু লিখব। ভাবছিলাম ইশতিয়াককে ফোন দিয়ে কিছু বলি। আমি শান্তনা দিতে পারি না খুব ভাল। আমি জানি না, কোনো স্বজন হারানো মানুষকে কি বলে শান্তনা দেয়া যায়! বিশেষ করে যখন কারো প্রিয় মানুষ খুন হয় নৃশংসভাবে খুন হয়, তাকে কি বলবো? সব ঠিক হয়ে যাবে - এই কথা বলবো? আমি এসব বলতে পারি না। কারণ, আমি জানি কিছুই ঠিক হয় না। এতো পরিমাণ ধর্ষণের বিরুদ্ধে লিখেছি যে আমি ভেতরে ভেতরে দূর্বল হয়ে গেছি। ফেসবুক বন্ধ করে প্রায়ই হারিয়ে যাই। পত্রিকার পাতায় ধ্বংসাত্মক হিংস্রতার খবরগুলো পড়তে সাহস হয় না। এই হিংস্রতা সহ্য করতে পারি না, নিতে পারি না। সত্যিই দূর্বল হয়ে গেছি।
কি লিখবো নতুন করে? নতুন করে বলার কি আছে? নতুন করে বলার আমাদের কিছু বলার না থাকলেও নতুন করে প্রতিদিনই হিংস্রতা চলছেই। এবার যা ঘটেছে ইশতিয়াকের ছয় বছর বয়সী বোনটার সাথেও৷ আয়েশা আক্তার নাম বাচ্চাটার। তাকে পাওয়া গিয়েছিল গামছা দিয়ে বাঁধা অবস্থায়, মুখে কাপড় গুজে রাখা।
বিকেল থেকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না আয়েশাকে। বাবা খবর পেয়ে দৌড়ে আসলেন। মা খুঁজলেন বাচ্চাটাকে। এর মধ্যেই খবর জানলেন, পাশের ভাড়াটে প্রতিবেশীর ঘরে তাদের কন্যা। বাবা মার একমাত্র কন্যা সন্তান আয়েশা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে তখন। আয়েশার ভাই ইশতিয়াক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়ে। বুঝতে কষ্ট হয় না, একমাত্র বোনটা কত আদরের৷ সেই বোনটার সাথে এমন নৃশংসতম ঘটনা ঘটবে তা ঘুনাক্ষরেও কে ভেবেছিল!
হাত দুটো বাঁধা৷ মুখে কাপড় গোঁজা। বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। কি অসহায়ত্ব৷ কি কষ্ট। ছয় বছর বয়সী বোনটা আমাদের কি করে সহ্য করেছিল, কেমন যন্ত্রণা তাকে দেয়া হয়েছিল! জানেন, যে ছেলেটাকে আয়েশাকে ধর্ষণ চেষ্টা করেছে তার বয়স কত? মাত্র ১৪! ভাবুন, বিকৃতির স্তর কতটা নিচে নেমেছে! একটা ১৪ বছর বয়সী ছেলে একটা বাচ্চা মেয়ের উপর নির্যাতন চালিয়ে খুন করে ফেলছে, এটা কোন সমাজ!!
আপনাদের কারো বোন আছে? আয়েশার কথাটা ভেবে একবার তার দিকে তাকান। আয়নার দিকে তাকান। ভাবুন, আমরা কি নির্মম এক জগৎ গড়ে তুলেছি আমাদের চারপাশে। আমরা কেন ব্যর্থ হয়ে গেলাম এভাবে, কেন আমাদের মাথাগুলো খেয়ে নিয়েছে শকুনে শেয়ালে, কেন এই বিকৃতি চারদিকে...
ঘটনার বিবরণ লিখেছে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত সাগর। সে লিখেছে,
"আয়েশা আক্তার ইয়াসফা। আমার ডিপার্টমেন্ট এর বন্ধু ইশতিয়াকের একমাত্র ছোট বোন। বয়স ৬ বছর। ওর কোন ভাই নাই৷ একটি মাত্র বোন ছিল। গত বৃহস্পতিবার সকালেও হয়তো সারাটি ঘড় দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কে জানতো যে ঐ দিনটাই হবে দুষ্টুমনির জীবনের শেষ দিন। ইশতিয়াকদের বাসার ২ বছরের বিশ্বস্ত ভাড়াটিয়ার ছেলে এনামুল (১৪) কৌশলে ইয়াসফাকে তাদের রুম থেকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মুখের মধ্য কাপড় দিয়ে গলা টিপে হত্য করে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে।
ইশতিয়াকের আম্মু ঐ ঘাতক ছেলেকে নিয়েই খুঁজতেছিল তার মেয়েকে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুজির পর যেই ঐ ছেলেকে নিয়ে তার বাসায় ঢুকলো আর ঘাতক পিছন থেকে দৌড়ে পালালো৷ আর এক মা পেল তার একমাত্র মেয়ের নিস্তব্ধ দেহ৷ দুপুরে গিয়েছিলাম বন্ধু ইশতিয়াক কে একটু শান্তনা দিতে কিন্তু একমাত্র বোন হারা ভাই আর একমাত্র কন্যা হারা মাকে শান্তনা দেয়ার মত কোন ভাষা আমার জানা নাই।"
জানেন ধর্ষণ চেষ্টাকারী, খুনি এনামুলের শাস্তির দাবিতে এখন নিস্পাপ শিশু আয়েশার ভাইকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। সেমিস্টার শেষ। এখন কিছুদিন আনন্দে কাটাবার কথা ছিল তার। অথচ, এখন কি নারকীয় একেকটা মুহুর্ত কাটাচ্ছে ছেলেটা। আমি তার জায়গায় বার বার নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি। আমি জানি কখনো ঠিক ওর এই সময়টা কিভাবে কাটছে, কি প্রগাঢ় শুণ্যতা নেমেছে ইশতিয়াকের বুক জুড়ে তা হয়ত বুঝতে পারব না। এই তীব্র দহনের ভাগ আসলে কাউকে দেয়া যায় না। কাউকে বোঝানো যায় না। কিন্তু, আমরা সমব্যথী হতে তো পারি।
ইশতিয়াকের আকুতি শুনবেন? সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীকালের মানববন্ধনে আসার অনুরোধ জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছে,
"কোন অপরাধে আমার নিষ্পাপ বোন ইয়াসফা খুন হল? পাপ পঙ্কিলতায় জরাজীর্ণ এই সমাজ কেড়ে নিল আমার বোনকে। এই ৬ বছরের বাচ্চাটা তো ভালো কি খারাপ কি তাই বুঝতো না।তাহলে কেন এত নিষ্ঠুরতা ওর সাথে ঘটে গেল।
ইয়াসফাকে এনামুল (হত্যাকারী) ধর্ষনের চেষ্টা করে, এবং তাতে ব্যর্থ হয়ে আমাদেরই ভাড়া বাড়ির খাটের নিচে আহত অবস্থায় মুখ-হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে।
আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আমার বোন মারা যায়।আমার বোনটা যে কতটা অসহায় বোধ করছিল তখন মায়ের ডাক শুনছে তবুও না দিতে পারছে উত্তর না পারছে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতে! ওর জীবনের ঐ সন্ধিক্ষণে এসে ও দুনিয়ার নির্মমতা একা একা সহ্য করছিল যা আমি কিংবা আমরা কেউ কখনোই বুঝতে পারবো না ওই অবস্থায় পরার আগ পর্যন্ত। আর কোনো ভাইকে যেন বোনের মৃত্যুতে এভাবে লিখতে না হয়, খুনির সর্বোচ্চ শাস্তি চাই.."
কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা বারোটায় মানববন্ধন করবে ইশতিয়াক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিচার চাইবে৷ ইশতিয়াকের বোনকে কি আপনার বোনের মতোই মনে হয় না? এই ঘুনে ধরা সময়ে যে কারোর স্বজনেরই যেকোনো সময় ভিক্টিম হবার সমূহ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই, আপনি কি পারেন, আওয়াজ তুলতে? বিচার চেয়ে ফেসবুকে দুইটা লাইন লিখতে পারেন বোনের জন্যে? বলতে পারেন, ইশতিয়াককে, তোমার বোন আমাদেরও বোন। আমরা তোমার পাশে আছি। বলতে পারেন?