আইয়ুব বাচ্চু কয়েক বছর আগে একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো বলেছিলেন। বুকের মধ্যে বিঁধেছিল কথাগুলো তখন। ভাবতেও পারিনি, এত দ্রুতই হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।

ভালোবাসা মানে ইচ্ছা করে জেনেশুনেই কষ্ট পাওয়া এবং ভালবাসলে কষ্ট পেতেই হবে। এরকমটাই মনে করতেন আইয়ুব বাচ্চু। নিজের স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, বাচ্চাকাচ্চা বড় হয়ে গেছে। এখন আমাকে ছেড়ে দাও। আমি পাখির মতো উড়ে যাই। পালাতে তার বড় ইচ্ছে করতো। বলতেন, আমি পালিয়েই যাব, কোথায় যে যাব নিজেও জানি না। সারাজীবন ধরে এমন কিছুই করেছি, আমার আর ভাল লাগছে না। ক্লান্তি ধরে গেছে। পালিয়ে যাব আমি। 

- কোথায় যাবেন? 
- আমি জানি না। হয় না মানুষ পালিয়ে যায় না, ওরকম চলে যাব। হলো তো অনেক। সবই বড় হয়ে গেছে, আমার চারপাশটা, সবাই স্যাটেল হয়ে গেছে। 
- তবে কি মিউজিকটা আর ভাল লাগছে না? 
- ওটাই একমাত্র ভাল লাগছে। আর কিছু না। যদি জানতে চান কাকে ভালবাসি, আমি আমার সবগুলো গিটারকে ভালবাসি। ওই আমার একমাত্র প্রেমিকা। 
- এমন কি হতে পারে, আপনি সব ছেড়ে ছুড়ে আবার বোহেমিয়ান জীবনে ফেরত যেতে চান? 
- হ্যাঁ, আমি বোহেমিয়ান হতে চাই, এখন আমার চাওয়াটা সেদিকে। আই ওয়ান্না বি লাইক বব মার্লে, আই ওয়ান্না বি লাইক আওয়ার গুরু আজম খান, যিনি নেই। 

একটা সময় আইয়ুব বাচ্চু ফেরারির মতো জীবনযাপন করেছেন। বোহেমিয়ান সেই জীবন কোনো এক্সিডেন্টাল ঘটনা না। একটা বনেদি পরিবারে জন্ম তার। অথচ, বুঝতে শেখার পর তিনি দেখলেন পারিবারিক বনেদিআনার কিছুই তাকে ছুঁতে পারছে না, টানছে না। তার ইচ্ছে বড় হতে হবে নিজের মতো করে। প্রয়াত আজম খানকে দেখলেন, লম্বা চুল, বোতাম খোলা শার্ট, ঝুঁকে গান গাইছেন, গিটার বাজাচ্ছেন। দেখে আইয়ুব বাচ্চুর মনে হলো, জীবনে আর কিছু চান না, তিনি এই কাজটাই করতে চান।

তারপর কত স্ট্রাগল, কত গল্পের পথচলা। বাবা চাননি ছেলে বাউলিয়ানা করুক। সতর্ক করেছেন, বাউলদের জীবনে অনেক কষ্ট পেতে হয়। ঘর ছাড়তে হয়েছে। বনেদিপনা, গিটার দুইটাই একসাথে করা যাবে না, তাই বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়েছেন। হাতে রুপালি গিটার নিয়ে ফিলিংস এর পর সোলসেও দশ বছর বাজিয়েছেন। মন ভরেনি। নিজেই ব্যান্ড খুলে ফেললেন। এলআরবি। তার মনে হয়, গিটার বাজাতে বাজাতে কতদূরে চলে এসেছেন, নিজেও জানেন না। খাপছাড়া লাগে মাঝে মধ্যে। 

- আপনার মধ্যে একটা ফ্রাস্ট্রেশন কাজ করছে, অস্থিরতা কাজ করছে। ডোন্ট ইউ থিংক ইউ আর সাকসেসফুল? 
- নো, নো। আইএম নট। আমি আমরা, আমরাই বলি, আমরা যারা ব্যান্ড মিউজিক করি, লোকে এটাকে মনে করে দে আর হ্যাভিং ফান। ফানের মধ্যেই আটকে ফেলছে আমাদের। কিন্তু, তারা এটা ভাবে না এই ফান যারা দেয়, তাদেরও একটা পেট আছে। আগে একটা সার্কেল ছিল। আমি মিউজিক বানাতাম, আপনি কিনতেন, উনি বিক্রি করতো, এই সার্কেলটা ভেঙ্গে গেছে এখন। কি যেন হয়ে গেছে এখন। 

একটা কষ্টের কথা জানতে চাওয়ার পর, খানিক চুপ করে বললেন, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কষ্ট আমার মায়ের আগে আমি যেতে পারলাম না। মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কষ্ট। কারণ, আমার কাছে খোদার পরেই মা। আমি আমার বাচ্চাদেরও বলি, আমি কি বলছি সেটা না, তোমাদের মা যা বলে সেটা শুনো। কারণ, শি নোজ দ্যা পেইন অফ ক্যারিং ইউ ফর দ্যা টেন মান্থস।  

আইয়ুব বাচ্চু তাঁর বাবার কথাটা স্মরণ করেন। বাউলদের আসলেই জীবনে অনেক কষ্ট পেতে হয়। গান গেয়ে প্রথম আয় ত্রিশ টাকা। তারপর অনেককিছুই তো করলেন। প্রাপ্তির খাতায় কত কী যোগ হলো। তবুও, কি এক শূণ্যতা ভর করতো। তিনি চাইতেন, একটা একান্নবর্তী পরিবার, যেমন ছিল ছোটবেলায়। সবাই একসাথে থাকুক। কিন্তু হয় না। এই চাওয়াটা অযৌক্তিক এখন। জীবনে অনেক তো দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন আর এসব ভাল লাগে না। হারিয়ে যেতে চান। এমনও হতে পারে, একদিন ছন্নছাড়া হয়ে রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ তাকে চিনছে না।

আইয়ুব বাচ্চু কয়েক বছর আগে একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো বলেছিলেন। বুকের মধ্যে বিঁধেছিল কথাগুলো তখন। ভাবতেও পারিনি, এত দ্রুতই হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কেউ কি আইয়ুব বাচ্চুর হাসি শেষে নিরবতাগুলো ধরতে পেরেছিল? জানি না। আচ্ছা, এমন কি সত্যিই হতে পারে, তিনি এই শহরেই থাকবেন, আমরা তাকে চিনবো না আর? আজকে আর তার কোনো গান শুনবো না। অভিমান আমাদেরও হয়, কষ্ট পেতে চাই না... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা