আয়ুষ্মান খুরানা: বলিউডের বন্ধুর পথে এক আউটসাইডারের টিকে থাকার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভালো স্ক্রিপ্টের কদরটা আয়ুষ্মান খুরানার মতো আর কেউ বোঝে না বলিউডে। সেটার পুরস্কারও হাতেনাতেই পাচ্ছেন তিনি। খানদের সিনেমাও যখন এক সপ্তাহের মাথায় সিনেমা হল থেকে নেমে গেছে, সেখানে আয়ুষ্মানের আন্ধাধুন টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়েছে!
২০১৮ সালে মাত্র চৌদ্দ দিনের ব্যবধানে দুটো সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল আয়ুষ্মান খুরানার। প্রথমটা ছিল আন্ধাধুন, সেটা বক্স অফিস হিট, সঙ্গে দারুণ প্রশংসা পেয়েছে ফিল্ম ক্রিটিকসদের কাছেও। দ্বিতীয় সিনেমাটা দিয়ে তো মোটামুটি তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন চারদিকে। 'বাধাই হো' নামের এই সিনেমাটা মুক্তির পরে প্রথম চারদিনেই ভারতের বাজার থেকে আয় করে নিয়েছিল ৪৪ কোটি রূপি! বাজেট মাত্র ২৫ কোটি হওয়ায় চারদিনেই হিট ডিক্লেয়ার করা হয়ে গেছে সেটাকে। বাধাই হো নিয়ে আয়ুশমান খুরানা প্রবেশ করেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সলো একশো কোটির ক্লাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, চারদিনের মাথায় বাধাই হো-কে যখন হিট ঘোষণা করা হলো, তখনও আয়ুশমানের আগের সিনেমা আন্ধাধুন অনেকগুলো হলে চলছে! দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দুটো হিট, দর্শকের ভালোবাসা, সেইসঙ্গে সমালোচকদের প্রশংসা, আয়ুশমান খুরানার একাদশে বৃহস্পতি ২০১৮ সালে ছিল তুঙ্গে! সেই বৃহস্পতির দৌড় পরের বছরেও আয়ুষ্মান বজায় রেখেছেন 'আর্টিকেল ফিফটিন', 'ড্রিম গার্ল' এবং 'বালা' দিয়ে।
তবে হ্যাঁ, এটাকে মুফতে পাওয়া বলা যাবে না কোনভাবেই। হুট করে ক্লিক করে গেছে, কিংবা ঝড়ে বক মরেছে, এই টাইপের কোন কিছুই ঘটেনি এই সিনেমাগুলোর বেলায়। আয়ুষ্মানও হঠাৎ করেই ভালো অভিনয় করে ফেলেননি আজ। শুরু থেকেই স্ক্রীপ্ট চয়েজ আর সিনেমা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দারুণ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়ে আসছেন তিনি। আর জোড়া সাফল্যটাও তার জন্যে নতুন কিছু নয়, ২০১৭ সালেও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মুক্তি পেয়েছিল তার দুই সিনেমা শুভমঙ্গল সাবধান আর বরেলি কি বরফি। সেই দুটোই বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল, কুড়িয়েছিল সমালোচকদের প্রশংসাও।
অভিনেতা হবার কথা ছিল না কখনও। অমৃতসরের সাদাসিধে এক কিশোর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরেই প্রথম অভিনয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। পাঁচ বছর থিয়েটার করেছেন সিরিয়াসলি, ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি তখন। ইংরেজী সাহিত্য আর কমিউনিকেশন স্টাডিজের ওপরে অনার্স-মাস্টার্স করা ছিল, সেই ডিগ্রিগুলো বেচেই জীবন চলে যাবে, ধরে নিয়েছিলেন এমনটা। গানের গলা ভালো ছিল, জনপ্রিয় গানগুলো নিজের মতো করে গেয়ে শোনাতেন বন্ধুদের আড্ডায়। আয়ুশমান নিজেই বলেছেন, তিনি শিল্পী হতে চেয়েছিলেন সবসময়। অথচ ভাগ্যের খেল দেখুন, অভিনেতা আয়ুষ্মানের আড়ালে গায়ক আয়ুশমান মোটামুটি ঢাকাই পড়ে গিয়েছেন!
আয়ুষ্মানের ফিল্ম ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকে খেয়াল করলে অদ্ভুত একটা জিনিস চোখে পড়বে। সিনেমার গল্পগুলো একটার সঙ্গে অন্যটার কোন মিলই নেই কোথাও। 'ভিকি ডোনারে'র পরে 'বেওকুফিয়ান', 'দম লাগা কে হাইশা' কিংবা 'মেরি পেয়ারি বিন্দু', তারপরে 'শুভমঙ্গল সাবধান' আর 'বরেলি কি বরফি', 'আন্ধাধুন', 'বাধাই হো', 'আর্টিকেল ফিফটিন', 'বালা', 'ড্রিমগার্ল', 'শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান', 'গুলাবো সিতাবো'- প্রতিবার নিজেকে ভেঙেছেন আয়ুশমান।
হ্যাঁ, কমন কিছু ফ্যাক্টর তো আছেই। ছোট শহর, খানিকটা আলাভোলা টাইপের চরিত্র, কারো সাতে-পাঁচে যে থাকে না বা থাকতে চায় না। সেগুলোকেই বারবার ভিন্নরকম ভাবে উপস্থাপন করছেন আয়ুশমান। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত আর্টিকল ফিফটিনে তিনি পুলিশ অফিসার হয়ে এসেছেন, সিংহাম বা চুলবুল পাণ্ডে টাইপের ডাকসাইটে পুলিশ নয়, হাজারটা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে একটু একটু করে লড়ে যাওয়া দায়িত্ববান একজন পুলিশ অফিসারের রোলে অভিনয় করছেন তিনি, যেখানে হিরোইজম নেই, নায়ক যেখানে উড়াধুড়া টাইপের সুপারহিরো হতে পারেন না, সেরকম সাদামাটা একটা ক্যারেক্টার। শুভ মঙ্গলের দ্বিতীয় কিস্তিতে সমকামীর চরিত্রে অভিনয় করে পরিচয় দিয়েছেন দারুণ সাহসিকতার। ক্যারিয়ারের পিক টাইমে এমন রিস্ক আর কেউ নিতো বলে মনে হয় না, আয়ুষ্মান নিয়েছেন।
প্রতিবার তিনি বেছে নিয়েছেন গল্পনির্ভর সিনেমাকে। ভিকি ডোনারের তুমুল সাফল্যের পরে অনেককিছুই করতে পারতেন তিনি, সিনেমার অফার তো শত শত পেয়েছেন। কিন্ত আয়ুশমান স্রোতে গা ভাসাননি, ধরে রেখেছেন নিজেকে। কাজ কম করবেন, কিন্ত করবেন মনের মতো করে। সেজন্যেই আট বছরের ক্যারিয়ারে মনে রাখার মতো অনেকগুলো সিনেমা যোগ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ভিকি ডোনারকে মুফতে পাওয়া ধরে নিয়েও বলা যায়, এমন ফিল্মোগ্রাফি যেকোন অভিনেতার জন্যেই ঈর্ষণীয় ব্যাপার! তিন বছরের মধ্যে শুভমঙ্গল সাবধান, বরেলি কি বরফি, আন্ধাধুন, বাধাই হো, আর্টিকেল ফিফটিন, শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান- এর মতো সিনেমা ঝুলিতে জমা পড়াটা তো চাট্টেখানি কথা নয়!
সহজাত অভিনয়টা তার সঙ্গী। চেহারা ভালো, কিন্ত সেখানে দারুণ হিরোইজম লুকিয়ে নেই। যে চরিত্রগুলো তিনি করেন, সেগুলোও নায়কসুলভ নয়, মানে প্রচলিত অর্থে নায়ক বলতে আমরা যেরকমটা বুঝি, তেমনটা তো নয়ই। সেই চরিত্রগুলোকেই তিনি অসাধারণ করে তোলেন অভিনয়ের প্রতিভায়। পর্দায় দেখা মানুষটাকে তখন আর দূরের কেউ বলে মনে হয় না, বরং তাকে ফেলা যায় আমজনতার কাতারেই। চরিত্রের ভেতরে তিনি যেভাবে ঢুকে যেতে পারেন সহজে, ঠিক সেভাবেই ঢুকে যান দর্শকের মনের ভেতরেও।
বলিউডের এই বিশাল আঙিনায় আয়ুষ্মান পুরোপুরি আউটসাইডার একজন। বাবা-চাচা বা গডফাদার টাইপের কেউ ছিলেন না এখানে। পরিবারের মধ্যে সিনেমায় কেউ কখনও নাম লেখাননি। অমৃতসরের মতো ছোট একটা শহর থেকে উঠে আসা আয়ুষ্মান জানতেন, এই জায়গাটা চোরাবালিতে ভরা, এখানে টিকে থাকতে হলে কাজ দিয়েই থাকতে হবে। আয়ুষ্মান তাই শুরু থেকেই স্ক্রীপ্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সতর্ক থেকেছেন। সেটার পুরস্কারও হাতেনাতেই পাচ্ছেন তিনি। গত বছরে খানদের সিনেমাও যখন এক সপ্তাহের মাথায় সিনেমা হল থেকে নেমে গেছে, সেখানে আয়ুশমানের আন্ধাধুন টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়েছে!
একটা সময় ব্লগ লিখতেন তিনি, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি- সবকিছু নিয়েই অগাধ জ্ঞান তার, সেই জ্ঞানটাই হয়তো তাকে সাহায্য করেছে 'ভালো' আর 'কম ভালো'র মধ্যে পার্থক্যটা বজায় রাখতে। স্ক্রীনটাইম নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই কোন, চরিত্রটা অন্ধ নাকি বোবা, সেটাও তার মাথায় থাকে না একদমই। তিনি শুধু গল্পের সঙ্গে চরিত্রের সামঞ্জস্যতা খোঁজেন হন্যে হয়েই, যে গল্পটা তাকে শোনানো হচ্ছে, সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেই পা বাড়ান সামনের দিকে।
২০১২-১৩ সালে ভালো গল্পের অনেক সিনেমাও মার খাচ্ছিল, বলিউডের দর্শক তখনও কন্টেন্ট জিনিসটাকে সেভাবে গ্রহণ করেনি, ২০১৮-তে এসে যেভাবে করেছে। আয়ুষ্মান তখন হাল ছাড়েননি, নিজের রাস্তা থেকে সরে যাননি, লাইন বদলে উদ্ভট গল্পের সিনেমায় নাম লেখানোর কথাও ভাবেননি। 'বেওকুফিয়ান' বা 'মেরি পেয়ারি বিন্দু'র মতো সিনেমাগুলো খুব একটা ভালো করতে পারেনি বক্স অফিসে, তাতে দমে যাননি তিনি। সেই হাল না ছাড়া মানসিকতার পুরস্কারটা আয়ুষ্মান পাচ্ছেন এখন।
আর হ্যাঁ, ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতাটাও এগিয়ে রেখেছে আয়ুষ্মানকে। বাধাই হো সিনেমার কথাই ধরুন না। অমিত রবীন্দরনাথ নামের আনকোরা এক পরিচালক সিনেমা বানাবেন বলে ঘুরছিলেন দ্বারে দ্বারে। অভিনেতা হিসেবে বেশ কয়েকজনের কথাই ভেবেছিলেন, তার স্ক্রীপটটা পছন্দ হয়নি অনেকের, না করে দিয়েছেন তারা। বেচারা রবীন্দরনাথ আয়ুষ্মানের কাছেও গিয়েছিলেন আরেকবার হতাশ হবার মানসিকতা নিয়েই।
কিন্ত ভালো গল্পের কদরটা বলিউডে আয়ুশমানের থেকে ভালো খুব বেশি লোকে বোঝেন না, গল্পটা শুনে নিজের চরিত্রের গভীরতা কতটুকু, নায়িকার সঙ্গে প্রেমের সুযোগ কতটা পাওয়া যাবে সিনেমায়, এসব না ভেবেই রাজী হয়ে গিয়েছেন আয়ুষ্মান। তার বিশ্বাস ছিল, সিনেমাটা 'ক্লিক' করবে, করে গেছে। একজন অভিনেতার জন্যে এই ট্যালেন্টটা থাকাও যে খুব দরকার। সেটা আয়ুশমানের আছে বলেই টানা সাতটা হিট ফিল্ম যোগ হয়েছে তার নামের পাশে! ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটানো আয়ুষ্মান জ্বলছেন আপন তেজে, হাতে যে প্রোজেক্টগুলো আছে সেগুলোও যথেষ্ট প্রমিজিং। বলিউডের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাদের একজন তো এখন তিনিই!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন