গুরু আজম খানের তিনটি অমর গান তৈরির পেছনের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বন্ধুদের ক্ষ্যাপানোর জন্যে আজম খান লিখেছিলেন 'আলাল ও দুলাল'। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি “হাজি চান” নামের এক মুরুব্বি ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন গানটি বুঝি তাকে নিয়েই লেখা...
মাহবুবুল হক খান নাম বললে এখন কেউ এই নামে তাকে চিনবে না, যদিও এটাই ছিলো তার পুরো নাম। মানুষটা আজম খান। যুদ্ধের পর বাহাত্তরে উচ্চারণ ব্যান্ড গঠন করেছিলেন। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেককে ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে আজম খান পারফর্ম করা শুরু করেন।
“এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছু রবে না’গো” এবং “চার কালেমা স্বাক্ষী দেবে” গান দুইটা যখন বিটিভিতে প্রচারিত হলো তখনই হু হু করে বেড়ে গেলো উচ্চারণ ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা। অনেক জানতে ইচ্ছে করতো, কী করে এই মানুষটা এমন গান লিখেছেন, গান বেঁধেছেন। কারণ, তখনকার সময়ে প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে পপসঙ্গীত শুরু করাটা তার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু তিনি সেই দুঃসাহস করেছিলেন।
কিছু লোক প্রথমে সমালোচনা করলেও পরে অভ্যস্থ যখন হলো মানুষ, তারপর থেকে আজম খান হয়ে গেলেন গুরু, এক মহান কিংবদন্তি। ইউটিউবে দেখছিলাম কবির সুমনের সাথে আজম খানের কথোপকথন। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। গান গাইতে পারেন না। এমনই একটা সময়ে কবির সুমন দেশ টিভির একটি অনুষ্ঠানের জন্য রেকর্ড করলেন আজম খানের কিছু কথা। ছিলেন আরেক প্রখ্যাত গুণী শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনও।
সাবিনা হ্যান্ডিক্যাম ধরে ভিডিও করছেন। কবির সুমন প্রশ্ন করছিলেন। আজম খান তার সেই সরল সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিচ্ছিলেন। হাত নাড়িয়ে, কি সুন্দর করে, কি অসাধারণ সরলতায় তিনি কথা বলেন! দেখে মন খারাপ হয়ে যায়! মহান শিল্পীরা এমনই হয় বোধহয়, একদম ডাউন টু দ্য আর্থ।
যাইহোক, আজম খান কালে কালে বহু কালজয়ী গানের সৃষ্টি করেছেন। তার অমর তিনটি গানের পেছনের গল্পগুলো একটু লিখে রাখি। মানুষ জানুক, স্বাভাবিক জীবন থেকেও কীভাবে গান লেখা যায়, গান বানানো যায়। পঁচাত্তরে আজম খানের সেই বিখ্যাত গানটি বের হয়, রেললাইনের ওই বস্তিতে, জন্মেছিলো একটি ছেলে…
এই গানের ইতিহাসটি এমন... ১৯৭৪ সালের কথা। দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হলো। তখন কমলাপুর থেকে নটরডেম কলেজের ফুটপাত মানুষে ভরপুর। মানুষ মারা যাচ্ছে। কবর দেওয়ার মানুষ নেই। মা তার দুধের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চাকে বিক্রিও করে দিচ্ছেন। তখন নতুন নতুন গান করতেন আজম খান।
ফুটপাতের বাচ্চাগুলো তাকে দেখলে মামা মামা বলে ডাকত। একদিন দেখেন এক বাচ্চা কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হইছে?' একজন বলল, 'মা বাচ্চাটারে রাইখা পলাইছে'। তীব্র হাহাকার হলো তার। লিরিক লিখতে বসলেন, প্রথম লাইন- রেললাইনের ওই বস্তিতে…। আজম খান গানের ভাষায় মনের বেদনা প্রকাশ করলেন। এই গানের পর ভীষণ একটা হৈ চৈ পড়ে যায়, আসমান ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান আজম খান। তার গানের ভাষার সাথে একাত্ম হয় সাধারণ মানুষ।
আজম খানের আরেকটি বিখ্যাত গান আলাল ও দুলাল। এই গানের একটা গল্প আছে।
রোজই জসীমউদ্দিন রোডের বাড়িটায় আড্ডা বসে, আড্ডার প্রধান চরিত্রদের মধ্যে ছিলো আপন দুই ভাই শাহাজাহান ও জাহাঙ্গীর। আড্ডার আরেক চরিত্র আলমগীর এই দুই ভাইকে আলাল দুলাল বলে ক্ষ্যাপাতো। আজম খান তখন ক্ষ্যাপানোর মাত্রাটাকে আরো পূর্ণতা দেয়ার জন্যেই কি না কে জানে, গান বাঁধলেন- আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি...
গান শুনলেই খানিকটা লজ্জার ভঙ্গিতে শাহাজাহান ওরফে আলাল এবং জাহাঙ্গীর ওরফে দুলাল মাথা নিচু করে থাকতেন। বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য আজম খান গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে।
মজার ব্যাপার হলো, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি 'হাজি চান' নামের এক মুরুব্বি ছিলেন। আলাল ও দুলাল গানটি শুনে তিনি ভীষণ মজে যান। মুরুব্বি হয়ত ভেবেছিলেন গানটি বুঝি তাকে নিয়েই লেখা। তিনি আজম খানের এক বন্ধুকে পেয়ে বললেন, ‘আজম খান তো গানটা জব্বর গাইছে। ওরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহো'।
আজম খান গিয়েছিলেন, গানও গেয়েছেন। সেই হাজি চান আপ্লুত হয়ে আজম খানকে বলেন, 'আপনে যে আমারে নিয়া গান বানাইসেন, মাগার ম্যাজিকটা দিসেন জব্বর'।
ওরে সালেকা, ওরে মালেকা গানের পেছনেও ইতিহাস আছে। জসীমউদ্দীন রোডের পাশে একটা হোটেল, টাওয়ার হোটেল। যুদ্ধের আগে সেই হোটেল নির্মাণাধীন। দোতলা হচ্ছে। সেই নির্মাণাধীন ভবনের উপর বসে আজম খান আড্ডা দিচ্ছেন পাঁচ ছয়জন বন্ধুর সাথে। নীলু তখন পানির ট্যাংকির ঢাকনাকে বানালো ড্রাম, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাজানো হচ্ছে কাল্পনিক ড্রামসেট।
নীলু এমনিতে দারুণ গিটারিস্ট। সে যখন ড্রাম বাজাচ্ছে সেটা বেশ জমে গেল। সবাই মজে গেল। আজম খানের মুখ দিয়ে হঠাৎ করে বের হলো, ওরে সালেকা, ওরে মালেকা.. একদমই পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। আড্ডার আসরে ফাজলামিতে সেটা মুখ দিয়ে এসে গিয়েছিল। সেই মুখের কথাই সেই আড্ডায় গানের মতো করে চলতে থাকলো। চললো, চার পাঁচ ঘন্টা।
তারপর কত কী হয়ে গেল, যুদ্ধের ডাক আসলো। আজম খান যুদ্ধে গেলেন। ফিরে আসলেন। দেখতে পেলেন, তরুণদের মধ্যে খানিক হতাশা। তিনি গান গাওয়া শুরু করলেন, তরুণদের জন্য, দেশের জন্য। একদিন মনে পড়ে গেল, অনেকদিন আগের সেই আড্ডার কথা। ভাবলেন, ওরে সালেকা, ওরে মালেকা এটা দিয়েই তো একটা গান রেকর্ড করা যায়। তারপর কাজ শুরু এবং তৈরি হয়ে গেল আরো একটি কালজয়ী বাংলা গান।
ওরে সালেকা ওরে মালেকা।
ও রে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে।।
পাশের গায়ে ছিল সে
রোজই যেতো এ পথ দিয়ে।
কেন? সাধনা তার! ভেঙ্গে গেল ও ও ও…।
সাঝের বেলায় নদীর তীরে সেই যে গেল এলো না ফিরে।
আজম খানের বেশিরভাগ গানই এমন। একটু অন্যরকম উপস্থাপনা কিন্তু একদমই জীবনঘনিষ্ঠ। সব কিছুকে দেখতেন তিনি সরল চোখে। জীবন যেরকম হয় আর কি। খুব মেকি কিছু না। এজন্যেই তার গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে এখনো, এবং গানগুলো বেঁচেও থাকবে অনন্তকাল। গানে গানে যিনি দেশকে দেখাতেন, মানুষের ভাষা, জীবন, যন্ত্রণা তুলে ধরতেন সেই অনুভূতিগুলো তো চিরন্তন। এজন্যেই টিকে থাকবে গানগুলো, আর হৃদয়ে থাকবেন, গুরু এবং সঙ্গীতের হিরো আজম খান!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন