মিজানুর রহমান আজহারি বেন্টলি চালাবেন নাকি টেসলা, সেটা নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে প্রসঙ্গটা যেহেতু উঠেছেই, কিছু কথা বলা দরকার...

রফিকুল্লাহ রোমেল: মাওলানা আজহারি (কিংবা আজহারী) নিয়ে একটা পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়েছে। এতটাই ভাইরাল যে কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম এটা নিয়ে সংবাদ ছেপেও ফেলেছে এর মধ্যে। ভাইরাল হওয়া কনটেন্টের মূল উপজীব্য মাওলানা সাহেবের কিছু ছবি। যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের একটা বেন্টলি গাড়ির সামনে পিছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। অন্য একটি ছবিতে তাঁকে বেশ স্মার্ট ভংগিমায় বেন্টলি ড্রাইভ করতেও দেখা গেছে।

পোস্টটি আমার শেয়ার করার স্পেসিফিক কারণ রয়েছে। পোস্টে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে অর্থ প্রতিদান নেয়ার কোন রেয়াজ নেই। এই নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কুরআন খুব ভাল করে জানেন এমন লোকজন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে ধর্ম শিক্ষা দিয়ে বা ওয়াজ করে পয়সা নেয়া যাবে না- এমন ব্যাখ্যা কুরআনে নেই।

আছে কী নেই সেই বিতর্কে আমি যেতে চাই না। কুরআন এর ব্যাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। সবগুলো মতামত শুনতে আমরা আগ্রহী। যারা এক্সপার্ট তারা নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাই দিবেন- আশা করতাম এক কালে। বিভিন্ন সময় কথিত বা পরিচিত লোকজন মারাত্মক ভুল ব্যাখ্যা বা মিথ্যা কথা বলেছেন দেখেই ঝামেলা লেগেছে বেশি। এই কারণেই সাঈদী ব্র্যান্ডটা অনেক বেশি অস্বস্তির জায়গা। মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে নয়। ধর্মীয় ইস্যুতেই। একই কারণে মাওলানা আজহারীও অনেক সন্দেহের উদ্রেক করেছেন। তার বক্তব্যেও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা আছে। বিতর্ক সেই জায়গাতেই হওয়া উচিৎ।

ঠিক একই কারণে বেন্টলি গাড়ি মাওলানা সাহেবের নিজের পয়সায় কেনা, নাকি গিফট, নাকি উনি ধার করে চালাচ্ছেন, তাতেও আমার কোনো আগ্রহ নেই। বক্তব্যটা খুব স্পষ্ট ছিল। ধর্মীয় মহান নেতা এবং মহাপুরুষদের, শুধু নবী ও রাসূল নন, সাহাবা, তাবেইন, তাবে-তাবেইন যাদের গল্পই আমরা শুনেছি, তাদের সবার একটা কমন ফ্যাক্টর আছে- সাদাসিধা জীবন ও কৃচ্ছতা সাধন। এটা নিয়ে বিতর্ক করার কোনো জায়গাই নেই। একদমই না।

নবীজী (সাঃ) কী ইনকাম করতেন, কত ইনকাম করতেন, ব্যবসা করতেন কি করতেন না, মদীনার শাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্যালারি পেতেন কি পেতেন না, সেটি মূখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হল তিনি কোন ফুটানি দেখাননি। তিনি ফুটানি দেখাতে চাইলে মক্কার ধনী আবু সুফিয়ান, পারস্যের সম্রাট বা আবেসিনিয়ার রাজা সবাইকেই অর্থ, প্রতাপ প্রতিপত্তিতে পিছনে ফেলতে পারতেন। নবীজী চাইলে প্রতিদিন "ভক্ত" মুসলিমরা উনাদের জন্য উপহারের বন্যা বইয়ে দিত। কিন্ত বাস্তবে এসব কখনো তো ঘটেইনি। ব্যাপারটা উল্টো। শুধু তিনি নন, খুলাফায়ে রাশেদীন, পরবর্তী আমিরুল মুমিনেরা যারা ধর্ম প্রচারক না শুধু, শাসক ছিলেন তাদের কাউকেই ধনসম্পদ বা পাওয়ার প্র্যাকটিসের ফুটানি দেখাতে দেখা যায়নি। আজহারির বেন্টলি চালানো- কেনা হোক, উপহার হোক আর রেন্ট করা হোক, উপরিউক্ত ধারণার সাথে একেবারেই যায় না। একদমই না। পিরিয়ড।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং আলোচনা দেখলাম। পলিটিকাল দুর্বৃত্ত লোকজন মার্সিডিজ চালাইতে পারলে কেন আজহারি পারবেন না? দুর্বৃত্ত পলিটিকাল হোক আর ধর্মীয় হোক, সে দুর্বৃত্ত। চুরি করা পয়সা, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া পয়সা, সব ধরণের সংজ্ঞায় কালো টাকার মালিক শেখ হাসিনা হলে উনিও দুর্বৃত্ত আর আজহারী বা অন্য মাওলানা হলে সেও দুর্বৃত্ত। শেখ হাসিনার নামটা ব্যবহার করা হলো এই জন্য যে উনি স্পষ্ট করেই বলেছেন- অনিয়ম ও দুর্নীতি যেই করুক, তাকে ছাড়া হবে না।

তো এমন তো না যে, পলিটিকাল লোকদের চুরি নিয়ে মানুষ কথা বলে না। বলে এবং সব চাইতে বেশি বলে। মাঝে মাঝে বানিয়ে বানিয়ে বলে। সত্যর সাথে মিথ্যা মিশিয়ে বলে। ভেরিফাই না করে অন্য জায়গায় শেয়ারও দিয়ে বসে। তো পলিটিকাল আর ব্যবসায়ী লোকদের চুরি বা সম্ভাব্য চুরি বা কল্পনাজনিত চুরি নিয়ে কথা বলা গেলে, মাওলানা বা পূজা কমিটির লোকদের নিয়ে কেন বলা যাবে না?

এই যে কিছু হলেই "আপনি কি ইসলামী স্কলার? আপনি কি তাফসীরে কুরআন?" তাহলে কুরআন নিয়ে কথা কন ক্যান- এই ন্যারেটিভ কি বাকস্বাধীনতা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে যায়? যদি অথেনটিক এক্সপার্ট ছাড়া কেউ ধর্ম রেফারেন্সে কথা বলতে না পারেন, তাহলে অথেনটিক পলিটিকাল একাডেমিক না হলে কি রাজনীতি নিয়েও কথা বলা বন্ধ করা উচিৎ নয়?!

এমন না যে পলিটিকাল লোকদের দেশের আইনে শাস্তি হয় না। শীর্ষ পলিটিকাল নেতা নেত্রীরা দুর্নীতির জন্য সাজা খাটছেন এবং খেটেছেন অহরহ। ক্ষমতাসীন লোকদেরও শাস্তি বা শাস্তির প্রক্রিয়া চলমান। ক্যাসিনো অপারেশন বা সম্রাটদের বিরুদ্ধে চালানো অভিযান তো পলিটিকাল লোকদেরই টার্গেট করা। এদের তো শাস্তিও হচ্ছে। দল ক্ষমতায় থাকার পরেও।

ডাক্তার-উকিলরা ট্যাক্স না দিলে মিডিয়ার সাংবাদিকদের কারো কারো কৌষ্ঠ্যকাঠিন্য হয়। সাংবাদিকদের মধ্যে বেশিরভাগের তো ট্যাক্সএবল বেতনই হয় না। আর বাকী সার্ভিস সেক্টরের সবার পিছনে এনবিআর তো আছেই। আছে আরো বিভিন্ন ধরনের সংস্থার নজরদারী। ট্যাক্সের চাইতে উপরি নিতেই আগ্রহী যারা বেশি বলে অভিযোগ আছে।

দেশের সকল পেশাজীবিদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা গেলে যারা 'ধর্ম শিক্ষা' (ধর্ম ব্যবসা বললাম না, অনেকের গায়ে লাগে) দিয়ে উপার্জন করেন তাদের কেউ হেলিকপ্টারে উঠলে বা বিদেশে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে গেলে সন্দেহ হলে বা বেন্টলি চালাইতে দেখলে কেন প্রশ্ন তোলা যাবে না?

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়া নাকি কালো টাকায় চলে। বিভিন্ন চ্যানেলের মালিকদের বিরুদ্ধে দুদক শত শত অভিযোগ এনেছে। অনেকের নাম পানামা পেপার পর্যন্ত উঠেছে। কিন্ত মিডিয়া তার ইচ্ছা মতো কনটেন্ট এখনো ডিস্ট্রিবিউট করতে পারে না। সেন্সরশীপ ছাড়াও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আছে। এছাড়া সাধারণ নাগরিকরাও এখন বিভিন্ন কারণে মত প্রকাশে ভয় পান বলে প্রায়ই শোনা যায়।

কিন্ত ধর্মীয় কনটেন্ট তো স্বাধীন। উনাদেরই একমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। উনাদের কনটেন্ট মনিটর করার কোনো সংস্থা কি আছে? সেন্সর করার কোনো প্রসেস আছে কি? কোনো ওয়াচডগ সংস্থা কি আছে? বিরোধী মিডিয়া, নিউজ পোর্টাল বা টিভি চ্যানেলের কথাবার্তা পছন্দ না হলে বিটিআরসি, র‌্যাব বা অন্যদের যে রকম তৎপর দেখা যায়, ওয়াজ বা কোনো ধরণের কোনো ধর্মীয় কনটেন্টের জন্য সেরকম কোনো প্রসেস আছে কি? না থাকলে, কেন নেই?

ডাক্তার-উকিল চেম্বার ফি কত নিবেন বা সকল ব্যবসার প্রাইস ট্যাগের একটা চার্ট থাকে। ওয়াজ করলে কত টাকা সর্বোচ্চ নেয়া যেতে পারে তার কোনো নিয়ম কোথাও কি আছে? না থাকলে কেন নেই?

এই 'ধর্মশিক্ষার' পুরো ইকোসিস্টেমটি দেশের অন্য সকল ইকোসিস্টেম থেকে পুরাই আলাদা। এদের পূর্ণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কন্টেন্টে কোনো সেন্সরশীপ নাই। সেন্সর করার নিয়মও নেই। ফ্রি কনটেন্ট না এগুলো। কনটেন্ট অউনাররা পয়সা নেন। সেই পয়সা নেয়ার কোনো ব্যারিয়ার নেই। সেই পয়সা কোথায় কীভাবে কোন দেশে চলে যাচ্ছে তার কোনো হদিসও নেই। এমনকি সেই প্রশ্নগুলো কখনো তোলা হয়নি। ওয়াজ করার জন্য এবং সেই ওয়াজ করে পয়সা নেবার জন্য কোনো স্পেসিফিক যোগ্যতা লাগে কিনা সেটাও কোথায় উল্লেখ নেই।

আজহারী হয়তো অনেক সুবক্তা। স্মার্ট আর ডিগ্রীধারী। কিন্ত তারিক মনোয়ার বা তাহিরির মতো যারা এন্টারকটিক, বেলগ্রেড বা অক্সফোর্ডের তিনবারের শ্রেষ্ঠ টিচার- তাদের মানুষের সামনে আসার নীতিমালা কী? জনস্বার্থে দেশের আইন কী বলে? আইন আছে কি আদৌ? নাকি এগুলো নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না? কেন?

কাজেই আজহারী নিজের পয়সায় বেন্টলি কিনেছেন কি ধার নিয়েছেন, কুরআনে ধর্মশিক্ষা দিয়ে পয়সা নেয়ার উদাহরণ আছে কি নেই, পলিটিক্যাল লোকজন মার্সিডিজ চালালে উনি কেন পারবেন না- এগুলো বিতর্কের কোনো কোর জায়গাই নয়। ফালতু তর্ক।

আশির দশকে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষের রাজনীতি নিয়ে দু ধারা ছিল। মধ্য নব্বই এ এসে সেটা স্ট্রাকচারাল পলিটিক্স বনাম আই হেইট পলিটিক্স ধারায় বিভক্ত হয়েছে। মিলিনিয়াম পর্বে এটা উন্নয়নের রেজিম বেইজড রাজনীতি বনাম সুশাসন কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিতর্কে রূপ নিয়েছে। এর ফাঁক দিয়ে কোথায় যে ধর্মীয় মব জাস্টিস পলিটিক্স বনাম মেইনস্ট্রিম পলিটিক্স বিতর্ক এবং তার স্বপক্ষে দুই ধারা জন্ম নিচ্ছে সেই খেয়াল আমাদের আছেতো?

"এই যে অমুক অমুক এই সেই যখন করিল, তখন আপনারা কই ছিলেন" বা "দেশের কোটি টাকা পাচারের সময় তোরা দালালেরা চুপ ছিলি" বলে যে নোশন সেটা কি উপরের কথাগুলা অসার প্রমাণ করে? করে কি?

এগুলো নিয়ে কথা বললেই যদি কেউ রাজনৈতিক দলের বা অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার দালাল হোন, তাহলে এগুলো নিয়ে যারা সত্য মিথ্যা মিশিয়ে গালাগালি করছেন তারা কার দালাল? আমরা কি চিনি তাদের? এই দুই ধারার কোন পক্ষে সমর্থন বেশি, সেটা নিয়ে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের একটা গণভোট করার সাহস আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম, জাপা কারো কি আছে? না থাকলে কেন নেই?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা