ধর্ষকদের ছবি ভাইরাল করার পাশাপাশি এই মানুষটাকে একটা ধন্যবাদ জানান, যিনি রুখে না দাঁড়ালে এমসি কলেজের নরপিশাচগুলো ধরা পড়তো না, 'মিটমাট' করার নামে পুরো ঘটনাটাই হয়তো ধামাচাপা দেয়া হতো...

সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে বেড়াতে আসা দম্পতির নির্যাতিত হবার ঘটনাটা এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি, ফোনকল ট্রেস করে পুলিশ ইতিমধ্যেই দ্রুততার সাথে তরুণীকে গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকা চার পিশাচকে গ্রেপ্তারও করেছে। অভিযোগ আছে, টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজে এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে, একই অভিযুক্তরাই ঘটিয়েছেন ন্যাক্কারজনক সেসব ঘটনা, কিন্ত লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগীরা মুখ খোলেননি আগে। এবারের ঘটনার ভিক্টিম স্বামী-স্ত্রী হওয়াতেই এটা আলোড়ন তুলেছে, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সেটা। 

ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ছবিতে ফেসবুক সয়লাব হয়ে গেছে, ভাইরাল হয়ে পড়েছে ছবিগুলো। ধর্ষকদের ছবি প্রচারের দরকার আছে, মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অমানুষগুলোকে চিনে রাখা প্রয়োজন সবার। তবে এই নিপীড়কদের পাশাপাশি আরও একটা লোকের ছবি এবং কাজ ভাইরাল হওয়া প্রয়োজন। যে মানুষটা না থাকলে সেদিনকার ঘটনাটাও হয়তো মিটমাটের নামে ধামাচাপা দিয়ে দিতো স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তিনি সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন বলে, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে দেশের মানুষ ঘটনাটা জেনেছে, অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে, বিচারও হবে। 

ভদ্রলোকের নাম মিহিত গুহ চৌধুরী বাবলা, তবে এলাকায় পরিচিতি বাবলা চৌধুরী নামে। তিনি নিজেও ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নারকীয় নির্যাতন শেষে স্বর্ণালঙ্কার এবং গাড়ির চাবি রেখে দিয়ে ধর্ষকের দল ভিক্টিম দম্পতিকে ছেড়ে দিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে এমসি কলেজের ক্যাম্পাস ছাড়া ওই দম্পতি তখন পুলিশে ফোন করে সাহায্য চাইছেন। তাদেরকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এলেন ব্যবসায়ী বাবলা চৌধুরী, জানতে চাইলেন কি হয়েছে। 

পরের ঘটনাগুলো বাবলা চৌধুরীর জবানবন্দীতেই শোনা যাক। স্থানীয় গণমাধ্যম সিলেট টুডে'কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- উনাদের মুখে সবটা শোনার পর আমি ফোন দেই শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। তবে পুলিশ আসার আগেই ওই দম্পতিকে নিয়ে ছাত্রাবাসের দিকে যাই দিই আমি। ছাত্রাবাসে গিয়ে সাইফুর-রবিউলসহ কয়েকজনকে দেখতে পাই। আমাকে দেখেই তারা ওই দম্পত্তির গাড়ি চাবি ও মোবাইল ফোন আমার হাতে তুলে দেয়। তারা এগুলো ফেলে গেছে বলে সাইফুর আমাকে জানায়। চাবি আর মোবাইল নিয়ে আমি পুনরায় ছাত্রাবাসের গেইটে এসে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

ছাত্রাবাসের গেইটে এসে দেখতে পাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা ও যুবলীগের একজন নেতাসহ কয়েকজন গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর কিছুক্ষণ পর পুলিশও ঘটনাস্থলে আসে। ছাত্রাবাসে প্রবেশের জন্য পুলিশ কলেজ প্রশাসনের অনুমতির অপেক্ষায় ছিলো। এতে অনেকটা সময় চলে যায়। এসময় জড়ো হওয়া সরকারদলীয় নেতারা প্রথমে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন। এরপর তারা আপোষের চেষ্টা চালান। আপোষের চেষ্টায় শাহপরান থানার ওসিও তাদের সহায়তা করেছিলেন। তবে আমি এরকম আপোষের প্রস্তাব মানিনি। এছাড়া কয়েকজন পুলিশ সদস্যও এরকম প্রস্তাবে রাজি হননি। তবে এসব কথাবার্তায় অনেক সময়ক্ষেপন হওয়ার সুযোগে অভিযুক্তরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বাবলা চৌধুরী, ছবি- ফেসবুক

ছাত্রাবাসে প্রবেশের আগেই ওই তরুণীর স্বামীর মোবাইলে একটি কল আসে। এসময় আমি তার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে কথা বলি। কল করেছিলো ধর্ষক সাইফুর। ফোনে ওই দম্পত্তিকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য শাসাচ্ছিল সে। আমি তখন আমার পরিচয় দিয়ে বলি- 'আমি আসছি, দেখি তোরা কী করতে পারস'।

এ তো গেল বাবলা চৌধুরীর নিজের বক্তব্য। এবার তার এক বন্ধুর জবানবন্দী ধার করা যাক। বাবলা চৌধুরীর এই বীরত্বগাঁথা ফেসবুকে ভাইরাল হবার পর বাবলাকে নিয়ে লিখেছেন তার বন্ধু, লেখক এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হাসান মুরশেদ। তিনি লিখেছেন, "বাবলা এক দুর্দান্ত সাহসের নাম। ১৯৯৬ এর আগে যখন এমসি কলেজে ছাত্রদল-শিবিরের সন্ত্রাসের মুখে জয় বাংলা উচ্চারনও করা যেতো না, মিছিলে ১০ জনও থাকতো না তখন বাবলাকে দেখেছি সন্ত্রাসের মুখোমুখি অটল দাঁড়াতে ছাত্রলীগের বাবলা। 

এমসি কলেজে ধর্ষিতা মেয়েটার স্বামী যখন টিলাগড় পয়েন্টে কাঁদছিলো, একটা মানুষ এগিয়ে যায়নি। বাবলা এগিয়ে গিয়ে বিস্তারিত জেনেছে। শুধু জেনেছে তাই নয়, সাথে লোকজন নিয়ে কলেজ হোস্টেলে ছুটে গেছে অপরাধীদের ধরতে, পুলিশকে বারবার ফোন দিয়ে  আনিয়েছে। পুলিশের ইতস্ততা, আরো দুয়েকজন নেতার সমঝোতার ফাঁকে ধর্ষকেরা পালিয়ে গেছে, কিন্তু বাবলা প্রত্যেককে চিহ্নিত করেছে। আমার বন্ধু বাবলা চৌধুরী বীর, বীরকে স্যলুট জানাতে হয়- তার পাশে দাঁড়াতে হয়।"

হাসান মুরশেদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার বন্ধু এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন, কারন বাবলা যেটা করেছেন, তাতে তাদের ভিত্তি নড়ে উঠেছে, প্রতিশোধ না নিয়ে তারা থামবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমনটাই ঘটে। ভালো কাজ করলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়ালে এমন পরিণতি আসন্ন। এখন সময় বাবলার পাশে দাঁড়ানোর, তাকে সাহস দেয়ার, তাকে জানানোর- এদেশের প্রতিটা বিবেকবান মানুষ বাবলার সঙ্গে আছে। 

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে যারা নারীদের মলেস্ট করে, রাজনৈতিক প্রভাবকে ব্যবহার করে যারা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধে লিপ্ত হয়, কিংবা যারা এসব অপরাধীদের শেল্টার দেয়ার চেষ্টা করে- এরা যতোই আওয়ামী লিগ করুক, যতোই বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলুক- তারা কখনও জয় বাংলার লোক হতে পারে না। জয় বাংলার লোক বাবলা চৌধুরীরাই, যারা নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ায়, ভয় না পেয়ে আপোষের প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেয়, যাদের কারনে প্রভাবশালীরাও মাথা নত করে পালাতে বাধ্য হয়। বাবলা চৌধুরী, আপনাকে স্যালুট! 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- সিলেট টুডে, হাসান মুরশেদ।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা