শুধু তাজমহলের পেছনেই প্রেমের ইতিহাস ছিল না! বাকরখানির ইতিহাসের পেছনেও রয়েছে এরকম এক মিথ, বাকের এবং খনি বেগমের অমর প্রেম!
চারশো বছরের পুরানো এই নগরী, চারশো বছরের ইতিহাস বয়ে বেড়ানো পুরান ঢাকা। পুরাণ ঢাকার অলি গলির মধ্য দিয়ে হাঁটছি। সরু রাস্তা। রিকশার টুং টাং শব্দ কানে আসছে। চারদিকে বিভিন্ন রকমের মানুষ। কেউ কেউ পান চিবুচ্ছে, ফচ করে পানের পিক ফেলে রাস্তা লাল করে দিচ্ছে। কোনো দোকানে মোহাম্মদ রাফির গান বাজছে। কত রকমের বাণিজ্য এখানে, বিরামহীন মানুষ।
তবু পুরান ঢাকায় কাউকে ক্লান্ত মনে হয় না আমার কেন যেন। সবার মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব। ভাষার মধ্যেও কিছু একটা আছে। তা নাহলে কিছুক্ষণ পুরান ঢাকার বাতাস গাঁয়ে লাগালেই ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতে ইচ্ছে হবে কেনো!
গিয়েছিলাম মূলত নান্নার মোরগ পোলাও খেতে। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে তারা মসজিদের পাশে এর প্রধান শাখা। আমরা প্রধান শাখায় না গিয়ে নাজিমউদ্দিন রোডের শাখায় গিয়েছি। ভীড় দেখে "মাথাই নষ্ট" অবস্থা। সিট সবসময় গরম থাকে, কারণ একজন উঠার সাথে সাথে আরেকজন গিয়ে সেখানে বসে পড়ে।
বেশি ভীড় ভাট্টার মধ্যে খাবার খেতে আমার ভালো লাগে না। অস্বস্তি হয় কিছুটা। তবুও খাওয়া দাওয়ার পর আমরা আসল মিশনে বের হলাম। মিশনের নাম "মিশন-বাকরখানি"। বাকরখানি সেইসব খাদ্যদ্রব্যের একটি যেটি মোঘল আমল থেকেই প্রচলিত। খাবারটিকে হয়ত সাধারণ মনে হতেই পারে, আসলে এর ইতিহাস কিন্তু অসাধারণ।
এই বিশেষ রুটি বা বিসকুট যা বলা হোক না কেনো এর উৎপত্তি মূলত আফগানিস্থান অঞ্চলে। বাংলাদেশে গম, দুধ, লবণ, ডালডা, ঘি, পনির এবং খামির দিয়ে বানানো এই জনপ্রিয় খাবারটি বাকরখানি নাম হয় নবাবী আমলের শেষ সময়ে। তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খানের সাথে এই খাবারটি নামকরণের বিশেষ যোগসূত্র আছে। আছে একটি ব্যর্থ প্রেমের করুণ ইতিহাস।
আগা বাকের ছিলেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর দত্তক পুত্র। তুর্কিস্থানের এক অভাগা বালক আগা বাকের এই দেশে এসেছিলেন ক্রীতদাস হয়ে। সুদর্শন বালকটিকে কিনে নিয়েছিলেন বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। বালকটি যে অন্য সবার চেয়ে আলাদা সেটি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। ছেলেটির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতা মুগ্ধ করে নবাবকে। নবাব ছেলেটিকে পড়ালেখা শেখানোর চেষ্টা করলেন। সাথে তাকে শেখালেন সমরবিদ্যা। অল্পদিনেই যুদ্ধবিদ্যায় দুর্দান্ত হয়ে ওঠে আগা বাকের নামক জোয়ান।
কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধে আগা বাকেরের পরাস্ত হবার উপক্রম। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগমকে দেখে আগা বাকেরের মন বলে এই মেয়েটি সামান্য নর্তকী নয়, সবার ভীড়ে তাকে আলাদা করে মনে ধরেছে আগা বাকেরের। সে প্রেমে পড়ে যায় খনি বেগমের, তার মনে প্রবল ভাবে বাজছে প্রেমের নৃত্য। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। খনি বেগমের প্রেমের মনোনয়ন প্রত্যাশী একমাত্র যুবক তো সে নয়।
উজির জাহান্দার খাঁর পুত্র জয়নাল খাঁও মারাত্মক পছন্দ করে খনি বেগমকে। জয়নাল নগর কোতোয়াল হতে পারে, কিন্তু ভালবাসার জন্য ভিন্ন রকমের সাহস লাগে। সে খনি বেগমের সামনে দাঁড়ালো, গিয়ে সত্যি সত্যি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো খনি বেগমকে। কিন্তু হায়! খনি বেগম উজিরের পুত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলো। জয়নাল মেনে নিতে পারলো না। সে খনি বেগমকে জোর জবরদস্তি করতে গেলে খবর পেয়ে আগা বাকের সেখানে যান। এটাই তো সুযোগ। তিনি জয়নালের সাথে মল্লযুদ্ধ শুরু করলেন। যে জিতবে খনি বেগম তার।
যুদ্ধে জয়নাল হেরে যায়। এইদিকে উজিরের কাছে মিথ্যা খবর দেয়া হয়। তাকে বলা হয়, তার ছেলে জয়নালকে আগা বাকের হত্যা করে লাশ গুম করে রেখেছে। উজির নবাবের কাছে বিচার চাইলে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ আগা বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার হুকুম দেন। কিন্তু এ যেনো সিনেমার চেয়ে বেশি কাল্পনিক। যেখানে বাঘের পেটে থাকার কথা সেখানে উলটা আগা বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ!
ইতিমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে। সে আগা বাকেরের অনুপস্থিতির সুযোগে জোর করে খনি বেগমকে ধরে নিয়ে যায় দক্ষিণ বঙ্গে। এই ফাঁকে বলে রাখি, আগা বাকের যৌবনে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর পর দীর্ঘদিন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি। তার নামে জায়গার নাম হয় বাকেরগঞ্জ।
যাই হোক, সেই দক্ষিণ বঙ্গে আটক খনি বেগমকে উদ্ধার করতে যান বাকের। তার পিছু নেন উজির জাহান্দার খাঁ। কিন্তু সেখানে আরেক নাটক হয়। উজিরের ছেলে জয়নাল যখন ক্রুদ্ধ হয়ে বাকেরকে হত্যার চেষ্টা করে, তখন উজির নিজেই নিজের ছেলেকে হত্যা করেন তলোয়ারের আঘাতে। জয়নাল তখন টলতে টলতে খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। সে হয়ত ভাবছিলো বেঁচেই যেহেতু থাকা হবে না, কাউকে সুখে রেখে যাওয়ার কী দরকার!
নাজির হোসেনের "কিংবদন্তীর ঢাকা" গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে লেখক বলেছেন, খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতিটা জাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের একটি শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে নাম দিয়েছিলেন বাকের-খনি। পরে মানুষের মুখে ঘুরতে ঘুরতে এই খাবারের নাম হয়ে যায় বাকরখনি।
উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশিত হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর "Dhaka Pachash Barash Pahley" গ্রন্থে ঢাকার বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের তৈরি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি প্রধানত গও জোবান, শুকি এবং নিমশুকি তিন ধরনের বাখরখানির কথা বলেন। চিনশুখা রুটিও একপ্রকার বাখরখানি যা বিশেষত চিনি দ্বারা তৈরি করা হয়। কাইচারুটি এবং মুলামও বাখরখানির অন্য প্রকারভেদ। পনির বাখরখানি হলো আরেকটি সুস্বাদু খাবার। এর প্রতিটি ভাঁজে ঘি ও গম বা সুজির পরিবর্তে হালুওয়া ব্যবহূত হয়। বৈবাহিক সংক্রান্ত উৎসবে প্রথার অংশ হিসেবে কনের বাড়ি থেকে বর এর বাড়ি কিচমিচ, কাঠবাদামের সাথে ক্রিম দুধ দিয়ে ডালায় করে পাঠানো হয় যা ভিগারুটি নামেও পরিচিতি।
পুরাণ ঢাকায় এই খাবারটি তুমুল জনপ্রিয় ছিলো একসময়। এখনো টিকে থাকলেও আগের মতো রমরমা অবস্থা নেই। আমাদের পাড়ায় একসময় তিন চারটা বাকরখনির দোকান ছিলো। এখন একটাও নেই। বাকরখনির বানানোর দৃশ্য বোধহয় পুরাণ ঢাকা ছাড়া বাইরে অন্য কোথাও খুব একটা দেখা মেলে না। পুরাণ ঢাকাবাসী ঐতিহ্যের টানে এখনো সকালে চায়ের সাথে বাকরখনি খান। কোনো কোনো দিন ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে তারা ফিরে যান মোঘল আমলে, বাকের-খনির প্রেমের স্মৃতি মাখা সুস্বাদু বাকরখনি থাকে তাদের হাতে...