কাশ্মিরের মানুষের ওপর ভারতীয় সেনাদের নির্যাতন নিয়ে আমাদের দেশের লোকজন যতটা প্রতিবাদ করে, তার এক পার্সেন্ট আলোচনাও বালুচদের ওপর পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতন নিয়ে হয় না। কাশ্মিরিরা আমাদের যে পরিমাণ সহানুভূতি পায়, তার কিয়দংশও বালুচিস্তানের মানুষকে পেতে দেখা যায় না কখনও!

সানা বালুচ এখন কোথায়, সেটা কেউ জানে না। তিনি বেঁচে আছেন, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটাও জানা নেই কারো। গত তিন মাস ধরে তিনি নিখোঁজ, কিন্ত তার পরিবারের সদস্যরা টু শব্দটিও করছেন না এ নিয়ে। বরং তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে, সানা বালুচ নামে কাউকে তারা চিনতেনই না কখনও! থানায় কোন কেস ফাইল করেনি কেউ, আদালতে মামলা করেনি, মিডিয়ার সঙ্গে কথাও বলেনি। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না হয়তো, কিন্ত সানার পরিবার প্রতিটা মুহূর্তে তার ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে। তারা জানেন, মুখ খুললে বা ছেলেকে ফেরত চাইলে ফলাফল খারাপই হবে, তারচেয়ে চুপচাপ থেকে যদি ছেলেটাকে ফেরত পাওয়া যায়, সেটাই ভালো। 

সানা বালুচ ছিলেন পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী স্বভাবের, কিশোর বয়স থেকে রাজনীতি সচেতন, আর তাই তারুণ্যের শুরুতেই স্বাধীন বালুচিস্তান আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ইসলামাবাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন সানা, ফেসবুকে স্বাধীন বালুচিস্তান মুভমেন্টের পক্ষে লেখালেখি করতেন, এই প্রদেশে পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনীর নেয়া নানা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতেন। আর সেটাই কাল হয়েছিল তার জন্য। 

করোনা লকডাউন শুরুর প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দেয়ায় বাড়ি ফিরে এসেছিলেন সানা। তবে তার কলম থামেনি, লিখছিলেন নিয়মিত, জারী ছিল প্রতিবাদ। লকডাউনের মধ্যেই একদিন তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সেনাসদস্য পরিচয় দেয়া কিছু লোক। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি। বালুচিস্তানে এটা অবশ্য নিয়মিত ঘটনা। সেখানকার স্বাধীনচেতা জনগনের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিপীড়নও নতুন কিছু নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাশ্মিরের মানুষের ওপর ভারতীয় সেনাদের নির্যাতন নিয়ে আমাদের দেশের লোকজন যতটা প্রতিবাদ করে, কাশ্মিরিরা যে পরিমাণ সহানুভূতি পায়, তার এক পার্সেন্টও বালুচিস্তানের মানুষকে পেতে দেখা যায় না কখনও!

গত তিন মাস ধরে নিখোঁজ সানা বালুচ

বালুচিস্তান হচ্ছে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। পাকিস্তানের মোট আয়তনের ৪৩ ভাগই বালুচিস্তান, অথচ শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়ন- সব দিক থেকেই পাকিস্তানে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রদেশের নাম বালুচিস্তান। অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় জনসংখ্যাও কম এখানে। গত ৭২ বছর ধরে বালুচরা লড়ছে স্বাধীনতার জন্য, কিন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রের মুখে চেপে ধরে রেখেছে তাদের। হাজার হাজার বালুচ তরুণ নিখোঁজ হয়েছে এপর্যন্ত, যারা আর ফিরে আসেনি। স্বাধীনতাকামী বালুচ নেতাদের গুলি করে মারা হয়েছে, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন- পাকিস্তানের মানচিত্রের বুকে রক্তাক্ত এক উপত্যকা হয়ে জেগে আছে বালুচিস্তান। 

বালুচিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তান যেটা করেছে, সেটাকে প্রতারণা বললে একটুও ভুল হবে না। দেশভাগের সময় ব্রিটিশরা কিন্তু বেলুচিস্তানকে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবেই ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তানও তা প্রথমে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সাতচল্লিশের অক্টোবরে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বেলুচিস্তানকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগেন। তখন বালুচ শাসক আহমেদ ইয়ার খানের ওপর নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করা শুরু হয়। তারপরও কিন্তু বালুচিস্তানের নিজস্ব পার্লামেন্টের দুটি কক্ষই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। এরপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আহমেদ ইয়ার খানকে বালুচিস্তান থেকে অপহরণ করে করাচি নিয়ে আসা হয়, সেখানে তাকে দিয়ে জোর করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবার দলিলে সই করানো হয়।

বালুচদের আন্দোলনকে পাকিস্তান বরাবরই দমন করতে চেয়েছে সামরিক শক্তি ব্যবহার করেই। আর সেটার সবচেয়ে কঠোর প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল ১৯৫৯ সালে নবাব নওরোজ খানের বিদ্রোহ দমনের মধ্যে দিয়ে। বালুচ নেতা নওরোজ খানের বয়স তখন আশিরও বেশি। পাকিস্তানের ‘ওয়ান ইউনিট’ নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি লড়াই শুরু করলেন, সঙ্গীদের নিয়ে শিবির করলেন এক পাহাড় চূড়ায়। পাকিস্তানি সেনারা তাকে বার্তা পাঠালো, পাহাড় থেকে নেমে এলে তাকে সেফ প্যাসেজ দেওয়া হবে। কোরান শরিফ ছুঁয়ে পর্যন্ত শপথ করা হল, আত্মসমর্পণ করলে তাদের কোনও ক্ষতি করা হবে না। 

নবাব নওরোজ খান

সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে নবাব নওরোজ খান দুই ছেলে-সহ মোট ১১জন অনুগামীকে নিয়ে নেমে এলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল। শুধু তাই নয়, কোর্ট মার্শাল করে তাদের সবার ফাঁসির সাজাও ঘোষণা করা হল। আশির বেশি বয়স বলে নওরোজ খান বাঁচলেন ফাঁসির হাত থেকে, তাকে দেওয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে সন্তান সহ দশ অনুগামীকে হারিয়েও নওরোজ খান দৃঢ় গলায় বলেছিলেন, বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন নিভে যাবে না কখনও। সত্যিই যায়নি। 

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে সেদেশের বিমানবাহিনী বালুচ স্বাধীনতাকামীদের দমনের নাম করে মিরাজ ও এফ-৮৬ ফাইটার জেট দিয়ে বালুচদের ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণ করেছিল, নিহত হয়েছিল শত শত নিরপরাধ বালুচ। ২০০৫ সালে বিদ্রোহী বালুচ নেতা নবাব আকবর বুগতি এক পার্বত্য গুহায় লুকিয়ে ছিলেন, পারভেজ মোশাররফের পাকিস্তানি সেনারা তার সেই গোপন ডেরা ঘিরে ফেলে তাকে হত্যা করেছিল। আকবর বুগতি কেবল বালুচ আন্দোলনের খুব বড় নেতাই ছিলেন না, প্রদেশের গভর্নর বা ফেডারেল সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত ছিলেন এক সময়। তবে তার মৃত্যুতে আন্দোলনে ভাটা পড়বে বলে মনে করা হলেও তা হয়নি। বরং তাতে আন্দোলনের তেজ অনেক বেড়ে গিয়েছিল, তিনি পেয়েছিলেন শহীদ বীরের মর্যাদা।

বালুচ নেতা আকবর বুগতি

এ তো গেল বালুচিস্তানের ইতিহাস, আর তাদের ওপর পাকিস্তানের নির্যাতনের বিবরণ। এর বাইরেও হাজার রকমের বঞ্চনা পোহাতে হয় বালুচিস্তানের মানুষকে। নিজের দেশেই তাদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবে ট্রিট করা হয়, যেমনটা একসময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে করতো পশ্চিম পাকিস্তানীরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বালুচ নাগরিকদের সংখ্যাটা একেবারেই হাতেগোনা, যে কয়জন আছে তারাও সৈনিক পদমর্যাদার। বালুচরা শিক্ষায় পিছিয়ে, শিল্পে পিছিয়ে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রদেশ এটি। বঞ্চনা আর নিপীড়নের এই গল্পগুলোই তিলে তিলে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে বালুচদের মনে। 

পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে বালুচিস্তানের সামরিক গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। সেটা শুধু আয়তনের কারণেই নয়, এর সমুদ্র সীমানাও বিশাল। গোয়াদর গভীর সমুদ্র বন্দরও এই বেলুচিস্তানেই। প্রাকৃতিক সম্পদেরও ছড়াছড়ি এই প্রদেশে। গ্যাস যেমন আছে, তেমনই আছে তামা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়ামের মতো বহু মূল্যবান খনিজ। অথচ সেগুলোর সুফল বালুচিস্তানের মানুষ পাচ্ছে না। তাদের সম্পদ দিয়ে করাচী-লাহোরের মতো প্রদেশগুলো আলোকিত হচ্ছে, অথচ তারাই পড়ে থাকছেন নিঃসীম অন্ধকারে। 

কাশ্মিরের সাধারণ জনগনের ওপর ভারতীয় সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে যারা সরব, বালুচিস্তানের জনগনের সঙ্গে পাকিস্তান কেমন আচরণ করছে সেটাও তাদের জানা উচিত। পুরো বেলুচিস্তানই একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কবলে থাকে সারাবছর। প্রতিটা শহর ও জনপদে সেনা বা ফ্রন্টিয়ার কোরের সদস্যরা মোতায়েন করা, বালুচরা কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ালেই তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। সানা বালুচের মতো শত শত তরুণ-তরুণী নিয়মিত নিখোঁজের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসেন, বেশিরভাগই আসেন না। ফলে বালুচিস্তানে আজ প্রকাশ্যে কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানোই অসম্ভব।

সেনাবাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন বালুচিস্তানে নিয়মিত ঘটনা

লেখার শিরোনামে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ছিল। এবার সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বালুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষজন বাংলাদেশকে তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখে। চব্বিশ বছরের মাথায় বাংলাদেশ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বালুচিস্তানের অজস্র মানুষ। পূর্ব বাংলার মতো বালুচিস্তানও পাকিস্তানের বঞ্চনা আর অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার। তবে সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশের একজন শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন, বালুচিস্তান এমন প্রভাবশালী নেতা কখনও পায়নি, যার অঙ্গুলি হেলনে কোটি মানুষ স্বাধীনতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। 

তাছাড়া বালুচিস্তানের সমাজ হচ্ছে গোত্রভিত্তিক। ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের নেতাদের মধ্যে সদ্ভাব কম, একারণে একতাও নেই, আর তাই সংঘবদ্ধ আন্দোলন বলতে যেটা বোঝায়, বড় আকারে সেটা কখনোই করতে পারেনি তারা। বালুচ নেতাদের বেশিরভাগই এখন দেশের বাইরে পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন, দেশে ফিরলেই প্রাণ যাবে তাদের, একারণে ফিরে এসে আন্দলনকে গতিশীল করাটাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, ২৫শে মার্চের গণহত্যার আগে বাঙালি কখনও অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি, মিছিলে বুক পেতে বুলেটের আঘাত সয়েছে, কিন্ত পাল্টা আঘাত করেনি। সেখানে বালুচরা অনেক আগে থেকেই সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তান সরকারের পক্ষে তাদেরকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দমন করাটা খুবই সহজ। 

বালুচরা আসলেই দুর্ভাগা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভারতকে পাশে পেয়েছিলাম, বালুচদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সেরকম কেউ নেই। আর তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাকিস্তানী সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতন সয়ে যাওয়াটাই তাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। তবে সেই নির্যাতনের গল্পগুলো কারো মনে দাগ কাটতে পারে না, এর চেয়ে কোটিগুণ বেশি দাগ কেটে যায় কাশ্মিরিদের কান্না, কে জানে, বালুচদের কান্নার জলে লবনাক্ততার পরিমাণ কম কিনা! নইলে প্রতিবাদ তো বালুচদের ওপর নির্যাতন নিয়েও হবার কথা ছিল...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা