ভারতের অন্ধপ্রদেশে নব্বইয়ের দশকে ছিল মদের রমরমা ব্যবসা। যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক অবক্ষয় ওঠে চরমে, বাড়ে নারী নির্যাতন। তখনই পূণ্যবতী শংকরার আবির্ভাব, লড়াই করে নিজেই গড়ে দিলেন ব্যবধান। অ্যালকোহল নিষিদ্ধ হয়ে গেলো গোটা অন্ধপ্রদেশেই!

সময় ১৯৯০ এর মাঝামাঝি। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের কিছু গ্রামে স্থানীয় পুরুষদের মধ্যে সে সময়ে দেখা যায় তীব্র অরাজকতা। বেশ সস্তা এক মদ 'আরাক' দেদারসে বিক্রি হওয়া শুরু করে অন্ধ্রপ্রদেশে। ভাত থেকে তৈরী হওয়া এই মদ ছিলো খুবই নিম্নমানের, কিন্তু পাওয়া যেতো খুব কম খরচে। তাছাড়া এই মদ বেশ কড়াও ছিলো। অন্ধ্রপ্রদেশে খুব অল্পসময়েই জনপ্রিয় হয়ে যায় এই মদ।

স্থানীয় পুরুষেরা এই মদ খেয়ে অধিকাংশ সময়েই মাতাল হয়ে পড়ে থাকতেন। বাড়ির সদস্যদের কারণে-অকারণে  মারধর করতেন। এবং কাজকর্ম না করে সারাদিন নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকায় ঘরের সঞ্চয়ে পড়তো টান। বাধ্য হয়ে ঘরের নারীরা টাকা উপার্জন করতে বাইরে বের হন৷ তাও নাহয় চলছিলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন স্বামীদের অত্যাচারের মাত্রা চরমে ওঠে। স্ত্রী'রা কায়ক্লেশে খেটে যে টাকা ঘরে আনতেন, সে টাকাও মদ খেয়ে উড়িয়ে দিতো তারা। তখন স্ত্রী'রা ভাবলেন, কিছু একটা করা দরকার। এই অরাজকতা বন্ধ হওয়া দরকার। সে সময়ে এই নারীদের ত্রাতা হিসেবে আসেন একজন। নাম তার- পূন্যবতী শংকরা।

'আরাক' তৈরি হয় প্রাচীন পদ্ধতিতেই!

পূন্যবতী শংকরা ছিলেন 'অল ইন্ডিয়া উইমেন্স ডেমোক্র‍্যাটিক অ্যাসোসিয়েশন' এর সম্পাদক। নব্বই এর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় পুরুষদের এই সহিংসতা তার চোখে পড়ে। নারীদের তখন দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এমনিতেই বাইরে নারীদের কাজের ক্ষেত্র খুবই সীমাবদ্ধ। তাছাড়াও যেসব জায়গাতে তাদের কাজের সুযোগ আছে, সেসব জায়গাতেও আবহাওয়াগত নানা বৈপরীত্যে তাদের কাজ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। এদিকে পরিবারেও পুরুষদের সহিংসতা বাড়ছিলো। একজন নারী সে সময়ে আত্মহত্যাও করে। তাছাড়া পরিবারের পুরুষদের মদ্যপ হয়ে সহিংসতার ঘটনাতেও অনেক নারীর মৃত্যু হয় বলে, অভিযোগ ওঠে সেসময়। পুন্যবতী শংকরা তখন বুঝলেন, মদ আছে এই সমস্যার গোড়ায়। এই মদকেই নিষিদ্ধ করতে হবে আগে।

প্রথমেই তিনি ও তার সংস্থা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী করা, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সচেতনতা বাড়ানোর কাজ শুরু করলেন। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুরু হলো কাজ। একতাবদ্ধ হয়ে মদ নিষিদ্ধ করার জন্যে কাজ করতে হবে... এই মন্ত্রে দীক্ষিত করা হলো সবাইকে।

এখানে আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখা দরকার, অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সরকার অ্যালকোহল বিক্রি থেকে প্রচুর রাজস্ব আদায় করে। এবং এই রাজস্বের বড় একটি অংশ আসে, মদ সরবরাহকারীদের লাইসেন্স নিলামের মাধ্যমে। পূন্যবতী তখন বুদ্ধি আঁটলেন, এই নিলাম অনুষ্ঠান ভন্ডুল করতে হবে৷ তাহলেই একটা বড়সড় ধাক্কা দেওয়া যাবে প্রশাসনকে।

নিলাম ঘোষণার দিন পুলিশের বেশ শক্তপোক্ত ব্যারিকেড ছিলো এলাকায়। তবুও স্থানীয় বিক্ষুদ্ধ মহিলারা সেই ব্যারিকেড ভেঙ্গে নিলাম অনুষ্ঠান পণ্ড করে দিলেন। এরপরেই তারা সাহস পেয়ে গেলেন। তাদের বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। এই বিক্ষোভের ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে 'আরাক' নামের সেই সস্তা মদ নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপর নারীরা বলেন, শুধু আরাক বন্ধ করলেই হবে না। সব মদ নিষিদ্ধ করতে হবে এই রাজ্যে৷

ভারতে মদ বিক্রির ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই

আস্তে আস্তে নারীদের অংশগ্রহন বাড়ছিল এই বিক্ষোভে৷ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এই আন্দোলনে সামিল হন। তারা যে আদর্শিক দিক থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তেমনটি বলা যাবে না। নারীদের এই আন্দোলনে সমর্থন দিলে, বিরাট সংখ্যক ভোট নিজের কব্জায় আসবে, এই আশাতেই তারা নিয়েছিলেন বিশাল সংখ্যক নারীদের পক্ষ। 

পরবর্তীতে রাজ্য সরকার অন্ধ্রপ্রদেশে অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব আর চিকিৎসাকাজ ব্যতীত বাকি সব কাজে মদ কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হয় পুরোপুরি। কিন্তু প্রকাশ্যে নাহয় বন্ধ হলো বিক্রি৷ কিন্তু গোপনে? গোপনে বেচা-বিক্রি ঠিকই চলতো। পূন্যবতী ও তার সংগঠন তখন গ্রামে গ্রামে গিয়ে এসব দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্ত করে এবং তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করে। ক্রমশ মদ বিক্রির পরিমাণ নেমে আসে একেবারেই তলানিতে।

তবে পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে রাজ্য সরকার পরিবর্তিত হলে অন্ধ্রপ্রদেশের মদ বিক্রির নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই শিথিল হয়ে যায়৷ ততদিনে নারীদের আন্দোলনের সেই জোরটাও কমে গিয়েছে অনেকটুকুই। তবুও পূন্যবতী এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। গত চল্লিশ বছর ধরে নারী আন্দোলনে জড়িত তিনি। সেই সময়ের মধ্যে মদ নিষিদ্ধের এই আন্দোলনটি অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। এবং পূন্যবতীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সাধিত হয়েছে এ আমূল পরিবর্তন। সেকারণে তাকে মনেপ্রাণে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানায় অন্ধ্রপ্রদেশের সেই নারীরা, এখনও।

অন্ধ্রপ্রদেশে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের আন্দোলনের অগ্রপথিক পূন্যবতী শংকরার এই নিরলস সংগ্রামের জন্যে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা