উপমহাদেশের রাজনীতি: নতুন সমীকরণের মুখে দাঁড়িয়ে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইমরান-হাসিনার ফোনালাপ, ভারতের অযথা মোড়লগিরি, ভারতকে ঠেকানোর জন্য চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি- সব মিলিয়ে উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ এখন বেশ খানিকটা ঘোলাটে...
পনেরো মিনিটের একটা ফোনালাপ যেন প্রলয় হয়ে এলো, সেই ঝড়ে ওলট পালোট হবার ইঙ্গিত দিচ্ছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ, শেখ হাসিনা এবং ইমরান খানের কথোপকথনের জেরটা যে লম্বা হতে চলেছে, সেটা তিন দেশের মিডিয়াতে চলা নানা রকমের রসালো আলোচনায় পরিস্কার। এরই মাঝে ভোরের কাগজ পত্রিকার বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু খবর প্রকাশ করেছে যে, গত চার মাসে বারবার সাক্ষাৎ চেয়েও নাকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাননি ভারতের রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলী। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বটাকে মাথায় রাখলে এটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা, এরইমধ্যে আবার শেখ হাসিনাকে ইমরান খানের ফোন- সব মিলিয়ে সাসপেন্সের চূড়ান্ত একদম!
ইমরান-হাসিনার ফোনালাপটাকে ভারত যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। আনন্দবাজার থেকে এনডিটিভি, দ্য হিন্দু থেকে দ্য ইন্ডিয়ান টাইমস- সবাই খবর প্রকাশ করেছে ইমরান খানের আচমকা বাংলাদেশের বন্ধু হতে চাওয়া নিয়ে। ভারতীয় গণমাধ্যমের একাংশে শঙ্কা, নরেন্দ্র মোদির ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির বলি হিসেবে বন্ধু রাষ্ট্র নেপালের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গেও তেমনটা হয় কিনা! এরকমটা ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ভারত সরকার অনেকটা জোর করেই নাগরিকদের ওপর ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অফ সিটিজেনশীপ এবং সিটিজেনশীপ অ্যামান্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা নাগরিকত্ব আইন চাপিয়ে দিয়েছিল। তখন ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা বাংলাদেশকে নিয়ে যা নয় তার বলেছিল। বাংলাদেশী শরণার্থীরা গিয়ে ভারতের জনসংখ্যা ভারী করছে, আসামের বিশ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া হবে- এমন কথাবার্তার সরাসরি কোন প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ তখন জানায়নি, কিন্ত এগুলোকে গুরুত্বহীন কথাবার্তা ভেবে উড়িয়েও দেয়নি।
এর বাইরে সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি বণ্টন সহ নানা অমীমাংসিত বিষয় তো ছিলই। গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তাকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি বলে খবর প্রকাশ করেছিল খোদ ভারতেরই পত্রিকা আনন্দবাজার। বন্ধুত্ব যত গভীরই হোক, এসব ইস্যু সামনে এলে সেই বন্ধুত্বের মান রাখাটা মুশকিল হয়ে পড়ে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো আর একপাক্ষিক হতে পারে না। আর সেকারণেই দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা এসে জমেছে, সেকারণে ভারতের রাষ্ট্রদূত চার মাস অপেক্ষার পরও শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না!
ঠিক এই জায়গাটাতে বাংলাদেশের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে পাকিস্তান। এই নাটকে আরও একটা চরিত্র আছে, সেখানে পরে যাচ্ছি, আগে পাকিস্তানের ব্যাপারে বলে নিই। আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেকদিন ধরেই কোণঠাসা এই দেশটা। ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বরাবরই আদায় কাঁচকলায়, বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কটা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল।
একাত্তরে গণহত্যা আর নির্যাতনের ব্যাপারে তারা তো ক্ষমা চায়নি আজও, বরং বাংলাদেশ যখন স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, তখন তারা বিরোধিতায় মত্ত হয়েছে। রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির পর সেদেশে গায়েবানা জানাজা হয়েছে, রাজাকার নিজামির ফাঁসিতে তারা পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেছে! পাকিস্তানের রাস্তায় পোড়ানো হয়েছে শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা। গত দুই বছর ধরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের অনুমোদন দেয়নি ঢাকা, রাষ্ট্রদূত ছাড়াই চলেছে হাইকমিশন!
আওয়ামী লিগ টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে শীতল সম্পর্কটা একটু উষ্ণতার দিকে যাচ্ছে। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনিই বুঝতে পেরেছেন, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ না হলে এই অঞ্চলে ভারতের সামনে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আর তাই নিজ দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন, ১৯৭১ সালের আগে যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে সেটাও স্বীকার করে নিয়েছেন। ভারত যখন পেঁয়ার রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশে, তখন চটজলদি পাকিস্তান তিন হাজার টন পেঁয়াজ পাঠিয়েছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীরও ভূমিকা আছে এতে।
এবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তান গেল। অদ্ভুত জগাখিচুড়ি টাইপের একঅটা শিডিউল ঠিক করা হলো, যেটা অনেকের কাছেই হাস্যকর লেগেছে, তার ওপরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার যা অবস্থা, তাতে সিরিজটা হবে কি হবে না, এটা নিয়েই প্রচুর সংশয় ছিল। তবে শেষমেশ সফরটা নির্ঝঞ্ঝাটে হয়েছে। তিন টি-২০, দুই টেস্টের ওই সিরিজটাকে শুধু ক্রিকেটের মধ্যে আটকে রাখার কোন উপায় নেই আসলে। এই সিরিজ আয়োজনের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেতে হয়েছে, কাজেই বাংলাদেশ সরকার যে এখন পাকিস্তানের প্রতি খানিকটা হলেও আগের চেয়ে উদারমনা, এতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের বন্ধুতা বা শত্রুতার ব্যাপারটা কিন্ত ত্রিমুখী নয়, ব্যাপারটা নিয়ে আরও একটা দেশের তুমুল আগ্রহ আছে। সেই দেশটার নাম চীন। বেশ কিছুদিন ধরেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে চীন, চাইছে ভারতকে একঘরে করে রাখতে। সেই চেষ্টায় এখনও পর্যন্ত তারা সফল। ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র নেপাল ইতিমধ্যেই ভিড়ে গেছে চায়নীজ ব্লকে, এবং পুরো ব্যাপারটায় ভারতের দাদাগিরির দোষটাই বেশি। চীন এখন চাইছে ভারত থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করতে, আর তাই অনেকগুলো গুটির একটি হিসেবে পাকিস্তানকে কাজে লাগাচ্ছে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের এমনটাই অভিমত।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ অনেকাংশে বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সব প্রোজেক্ট হচ্ছে চীনের অর্থায়নে, অন্যদিকে ভারতীয় অর্থায়নে বা ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত প্রজেক্টগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, শ্লথ হয়ে গেছে গতি। যেটা ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। সিলেটের এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে চীনা একটা কোম্পানীকে, এটাও ভারতের জন্য মাথাব্যথা, কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে চীনের নজরদারী বেড়ে যাওয়ার আশংকা আছে এতে, সীমান্তের এত কাছে চীনা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান দেখতে চায় না তারা। কিন্ত বর্তমান বাস্তবতায় তারা না পারছে কিছু রইতে, না পারছে সইতে।
আমরা আবার দ্য হিন্দুর সেই প্রতিবেদনটিতে ফিরে যাই। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি অংশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার কাজে সক্রিয়। ভারতপন্থী কর্মকর্তারা এখন খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, কারণ বন্ধুত্বের নাম করে ভারত শোষকের আচরণই করেছে, বড়ভাই হয়ে স্নেহ দেয়ার পরিবর্তে করেছে শুধু শাসন। আর সেকারণেই ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকদের অনেকে। তাতে আখেরে লাভ হবে বাংলাদেশের, চীনা বিনিয়োগ তাতে আরও বাড়বে। নইলে পাকিস্তানের বন্ধুত্বের জবাবে ঢাকা এতদিন যেভাবে শীতলতা ধরে রেখেছিল, আচমকা সেখান থেকে অবস্থান বদল ঘটার কথা নয়।
কূটনীতি খুব জটিল জিনিস। এখানে চিরস্থায়ী শত্রু বা চিরস্থায়ী মিত্র বলে কোন ব্যাপার নেই। অতীতকে অস্বীকার করে ভারতীয় বলয় ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বন্ধু হয়ে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, তবে ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে বন্ধুত্ব না হলেও, পাশাপাশি সহাবস্থানের কথা একদম উড়িয়ে দেয়ারও কোন উপায় নেই। একদিকে ভারতের অযথা মোড়লগিরি, অন্যদিকে ভারতকে আটকানোর জন্য চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি- সব মিলিয়ে উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ এখন বেশ খানিকটা ঘোলাটে। কূটনীতির এই কুয়াশা কাটতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে বলেই মনে হচ্ছে আপাতত...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন